আবগারি শুল্ক বাড়াতে মদ্যপানে উৎসাহ দান এক ভয়ঙ্কর ঝুঁকি!
মুহাম্মাদ নূরুদ্দীন, টিডিএন বাংলা: রাজ্য সরকারের আবগারি দপ্তর এখন মদ বিক্রিতে জোর দিয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি সংবাদ থেকে জানা যায়, মদ বিক্রি বাড়াতে ‘হয় ভাতা, নয় জরিমানা’ নীতি নিচ্ছে আবগারি দপ্তর। করনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারের আবগারি দপ্তর মদ বিক্রি বাড়িয়ে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি পূরণ করতে চায়। তাই তারা মদ বিক্রেতাদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-মাত্রা বেঁধে দিতে চায়। বছরে নিদেনপক্ষে কত পরিমান মদ বিক্রি করতে হবে তা নির্ধারিত করে দেবে সরকার। যা পূরণ করলে বিক্রেতারা উৎসাহ ভাতা পাবেন। আর যদি কোন বিক্রেতা লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে না পারে তাহলে তাদেরকে জরিমানা দিতে হবে। শুধু বিক্রেতাদের নয়, বরং প্রতি জেলার আবগারি অফিসারদেরকে ও নির্দিষ্ট টার্গেট দেয়া হবে। সূত্রের মাধ্যমে জানা যায়, আগামী বছরে আবগারি দপ্তর থেকে বার্ষিক অন্তত কুড়ি হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে চায় সরকার। বর্তমানে যার পরিমাণ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা।
শুল্ক বাড়াতে সমাজে মাদকদ্রব্যের বিক্রয় বাড়ানোর পরিকল্পনা যেকোনো সরকারের দেউলিয়াপনার পরিচয় বহন করে। সংসার চালাতে আয়-রোজগারের দরকার হবে কিন্তু কোন পথে উপার্জন করতে হবে সেটা সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। সংসার চালাতে আপনার টাকার প্রয়োজন তাই বলে আপনি আপনার সন্তানদেরকে লোকের পকেট মেরে, খুন রাহাজানি চুরি ডাকাতি করে উপার্জন করে আনতে বলবেন না। কেননা আপনি জানেন এই পথে উপার্জন করা শুধু অসৎ নয় বরং এটা সামগ্রিকভাবে অনেক বিপদের ঝুঁকি। গোটা সমাজের জন্য ক্ষতির কারণ। তাই আপনি কস্মিনকালেও এই ধরনের পথ অবলম্বন করেন না। শুধু তাই নয়, সাধারণভাবে আমরা সকলে এই ধরনের কাজকর্ম কে চরম অপরাধ বলে জানি এবং এই ধরনের অপরাধ থেকে সমাজকে মুক্ত করার জন্য সচেষ্ট থাকি। আফিম চাষ করে, তামাক জাতীয় দ্রব্য চাষ বাড়িয়ে উপার্জন করার চেষ্টা করা কোনমতেই সমাজের জন্য কল্যাণকর হতে পারেনা। যদি উপার্জনের জন্য চুরি, ডাকাতি খুন রাহাজানিকে উৎসাহিত করা হয় তা যেমন সমাজে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে তেমনি মদ সেবনকে উৎসাহিত করা হলে তার থেকে কয়েক শত গুণ বেশি বিপর্যয় ডেকে আনা হয়। মদ্যপান শুধু শরীর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয় বরং তা যে সমাজের জন্য এক ভয়ঙ্কর ক্ষতির কারন সে ব্যাপারে মনে হয় দ্বিমতের কন অবকাশ নেই।
মাদক , দ্রব্যের নেশা বাড়িয়ে দেয় অপরাধের প্রবণতা। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্যের ভিত্তিতে সংগঠিত সমীক্ষা বলছে, মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের সত্তর থেকে পঁচাত্তর শতাংশের জন্যই দায়ী মদ্যপান। মদ্যপানের জন্য দেশে প্রতি ছিয়ানব্বই মিনিটে একজনের মৃত্যু হয়।
অনেকে মনে করেন মদে অনেক উপকার আছে। কিন্তু তা সত্য নয়। মদ মানেই ক্ষতি। মদের কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই। মদ পান করলে ক্ষতি হবেই। গবেষকরা এই প্রথমবারের মতো একসুরে এসব কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজ নামের বৈশ্বিক উদ্যোগের গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে। আমেরিকার ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিকস এই বৈশ্বিক উদ্যোগের প্রধান কার্যালয় হিসেবে কাজ করেছে। গবেষণায় অর্থায়ন করেছে আমেরিকার বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন।
এই গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বিশ্বে প্রতি তিনজনে একজন মদ পান করে। অপরিণত বয়সে মৃত্যু ও প্রতিবন্ধিতার জন্য সপ্তম ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাস মদ্যপান। আজ আমরা করোনা ভাইরাসের আক্রমন থেকে বাঁচার জন্য কী না করছি।অথছ বিশ্বে প্রতিবছর ২৮ লাখ মানুষ মারা যায় মদের কারণে। মদের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে ব্রিটেন ভিত্তিক জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী দ্য ল্যানসেট’র প্রবন্ধেও এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
১৯৯০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ১৯৫টি দেশে মদের ব্যবহার, অসুস্থতা ও মৃত্যুর তথ্য এতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে গবেষকেরা বলেছেন, মদের কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই। প্রবন্ধে বলা হয়, ডেনমার্কের মানুষ সবচেয়ে বেশি মদ পান করে। সবচেয়ে কম মদ পান করা দেশগুলোর তালিকায় আছে মুসলিম দেশগুলো। ইসলামে মদ পান হারাম।
গবেষকেরা বলছেন, ১৫-৪৯ বছর বয়সী মানুষের ১০টি মৃত্যুর মধ্যে একটি ঘটে মদের কারণে। নিয়মিত মদ্যপান শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ও টিস্যুতে বিরূপ প্রভাব ফেলে। মদে অভ্যস্ত মানুষ সহিংস হয় এবং অনেক সময় নিজের ক্ষতি করে। বিশ্বব্যাপী মানুষ কী পরিমাণ মদ পান করে, সেই হিসাব বের করতে গবেষকেরা ৬৯৪টি পূর্বের গবেষণা পর্যালোচনা করেন। এ ছাড়া মদের স্বাস্থ্যঝুঁকি নির্ণয়ের জন্য আরও ৫৯২টি গবেষণা প্রবন্ধ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এসব পর্যালোচনা শেষে গবেষকেরা বলছেন, ৫০ বছরের বেশি বয়সীদের ক্যানসারে মৃত্যুর পেছনে প্রধান কারণ মদ্যপান।
২০১৬ সালের বৈশ্বিক তথ্যে দেখা গেছে, ২.২ শতাংশ নারী ও ৬.৮ শতাংশ পুরুষের অপরিণত বয়সে মৃত্যুর কারণ মূলত মদ্যপান। ১৫-৪৯ বছর বয়সীদের প্রধান মৃত্যুঝুঁকি ছিল মদসংশ্লিষ্ট কারণ। এছাড়া ৫০ বছর বা তার বেশি বয়সীদের ২৭ শতাংশ নারী এবং ১৯ শতাংশ পুরুষ মারা যায় মদ্যপানসংশ্লিষ্ট ক্যানসারের কারণে।
পা থেকে মস্তিস্ক পর্যন্ত সারা দেহই আক্রান্ত হয় মদের কুপ্রভাবের দ্বারা। অ্যালকোহল শরীরে বিপাকের মূল অঙ্গ লিভার। মদপানে এই লিভারের বারোটা বেজে যায়। ফ্যাটি লিভার, জন্ডিস, লিভার বড় হয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে লিভার সিরোসিস নামের ভয়ংকর রোগ পর্যন্ত হতে পারে। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হলে অকালে মৃত্যুবরণের আশংকা বেড়ে যায় অনেকখানি। হতে পারে লিভার ক্যান্সার যার ফলাফল নিশ্চিত মৃত্যু।
বুকজ্বালা, গ্যাস্ট্রিক আলসারের সমস্যা বেড়ে যায়, অগ্নাশয়ে হতে পারে প্যানক্রিয়াটাইটিস বা আগ্নাশয়ের প্রদাহ যা খুব মারাত্নক। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করলে এটা রোগীর জীবনাবসান করাতে পারে। মুখগহবর, শ্বাসনালী ও খাদ্যনালি, কোলন বা বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারেও মদিরার ভূমিকা আছে।
কিডনির আকার বাড়িয়ে দেয়া, কাজের ব্যাঘাত ঘটিয়ে কিডনির হরমোনের ব্যালান্স নস্ট করা, কিডনি বিকলে ভূমিকা রাখার মতো দুষ্ট কাজে মদের হাত রয়েছে।
অতিরিক্ত মদপানের কারনে হৃদরোগের সমস্যা হতে পারে। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়, উচ্চরক্তচাপের আশংকা বাড়ে। ওজন বাড়তে পারে, হৃদপেশী বিকল হয়ে হার্টফেইলর বা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াও বন্ধ হতে পারে।
হতে পারে মস্তিস্কে স্ট্রোক, ডিমেনশিয়া বা স্মৃতি ভ্রষ্টতা। মদপানকারীর মানসিক স্বাস্থ্যেরও বেশ অবনতি ঘটে। বিষণ্ণতা, দুশ্চিন্তা, মানসিক অস্থিরতা, অনিদ্রা, কাজে একাগ্রতার অভাব সব কিছু মিলিয়ে একজন সুরাসক্ত মানুষ মনের দিক থেকে খুবই অশান্তিতে থাকেন।
গর্ভবতী মা যদি মদ পান করেন তবে আগত সন্তানের মারাত্নক জন্মগত ত্রুটি দেখা দেয়। শিশুর শারীরিক গঠনে অস্বাভাবিকতা থাকে, মস্তিস্কের স্বাভাবিক পরিবর্ধন ও পরিবর্তন হয় না এবং এসব সমস্যার কোন সমাধান নেই।
যারা অল্প সময়ে প্রচুর অ্যালকোহল গ্রহণ করেন তাদের ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ সমস্যা দেখা দেয়, বাংলাতে যাকে আমরা মাতলামি বলতে পারি। মাতাল ব্যক্তি তার নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলেন, চলাফেরা ও কথাবার্তায় অসংলগ্নতা দেখা যায়। মানসিকভাবে উত্তেজিত হয়ে অপরের সাথে ঝগড়া, মারামারি করতে পারেন। মাতাল অবস্থায় গাড়ী চালাতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় অনেকেই মারা যায়। আমাদের দেশে বাস-ট্রাক ড্রাইভারদের অতিরিক্ত এক্সিডেন্টের অন্যতম কারণ এই মদাসক্তি। অনেকে অ্যালকোহলের বিষক্রিয়ায় মারাও যেতে পারেন যারা একবারে অনেক বেশি পরিমাণে অ্যালকোহল পান করে ফেলেন।
মদ এত ভয়ঙ্কর জানা সত্ত্বেও শুধুমাত্র শুল্ক আদায়ের লক্ষ্যে সরকার যদি মদ বিক্রয় ও সেবনে মানুষকে উৎসাহিত করে তবে তা চরম ভুল করা হবে। মদ পান করার কারণে সমাজে যে পরিমাণ ক্ষতি হয় এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকারকে তার কারণে যে মাশুল গুনতে হয় তার পরিমাণ আবগারি শুল্কের থেকে কয়েক শতগুণ বেশি।মদ পান করে গাড়ি চালানো রোড এক্সিডেন্ট অন্যতম কারণ। এতে যেমন মানুষ হতাহত হয় তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হয় গাড়ি। অনেক পরিবার পথে বসে যায়। এই ক্ষতি কিভাবে পূরণ করবে সরকার? মদ পান করার কারণে নানান রোগ নিয়ে মানুষকে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হতে হয়। সেই রোগের চিকিৎসা করতে ওষুধের পিছনে ব্যয় হয়। এই খরচের পরিমাণ কি আবগারি শুল্কের পরিমান এর থেকে কম? মদ না থাকলে এই
ক্ষতি গুলি হয়তো বরদাশ্ত করতে হত না। তাই আবগারি শুল্ক বাড়ানোর জন্য মদ বিক্রির প্রবণতা বানানোর চেষ্টা করা কতটা যুক্তিসঙ্গত তা কর্তৃপক্ষকে তা ভেবে দেখতে হবে।