দেশ

প্লাস্টিক দূষণের হাত থেকে নীরবে পরিবেশকে রক্ষা করে চলেছেন বাকশক্তিহীন হায়দার

নিজস্ব প্রতিনিধি, টিডিএন বাংলা, নদীয়া: প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বচ্ছ ভারত অভিযান শুরু করেছিলেন ২০১৪ সালে। কিন্তু তারও অনেক আগে থেকে নীরবে স্বচ্ছ এলাকা অভিযান শুরু করে প্লাস্টিক দূষণের হাত থেকে পরিবেশকে রক্ষা করে চলেছেন বছর পঁয়ত্রিশের এই মূক ও বধির যুবক।

নদিয়ার নাজিরপুর হাগনাগাড়ী থেকে নতিডাঙ্গা করিমপুর। প্রায় বিশ কিমি এলাকায় তার অবাধ বিচরণ। আর সবটাই যেন তার নিজের। সবার ঘুম ভাঙার আগেই সে শুরু করে দেয় রাস্তার দুপাশ পরিষ্কারের কাজ। চায়ের দোকান থেকে গৃহস্থালি, কিংবা পথ চলতি মানুষ। সবার ফেলে দেওয়া ক্যারি, থার্মোকল, প্লাস্টিক এসবের প্রতিই ওর যত ক্ষোভ। দেখতে পেলেই এক জায়গায় জড়ো করে সেগুলি। পকেট থেকে গ্যাস লাইট বের করে ধরিয়ে দেয় আগুন। আর এভাবেই বাকশক্তিহীন এই যুবক বিনা স্বার্থে বিনা পয়সায় প্লাস্টিক দূষণের হাত থেকে পরিবেশকে রক্ষা করে চলেছেন বছরের পর বছর।

করিমপুর-২ ব্লকের থানারপাড়া থানা সংলগ্ন এই নির্বাকের বাড়ি। বাবা নেই। দরিদ্র দিনমজুর দাদার কাছেই মানুষ। ওদের অভাবের সংসারে কেউ খোঁজ রাখেনা। নাম তার হায়দার। কিন্তু এই নামে ক’জনই বা চেনে। ‘কালা’ নামেই সবার মুখে মুখে ফেরে হায়দার সেখ।

হায়দারের ভাই গাজলু সেখ জানাচ্ছেন, ‘ছোটবেলা থেকেই প্লাস্টিকের প্রতি ওর চরম ঘৃণা। মানুষের ক্ষতি হবে হয়তো এটাই ভেবে দুহাতে সুন্দর ভাবে গুছিয়ে ওগুলি পুড়িয়ে দেয়। কথা বলতে পারে না বলে স্কুলেও যাওয়া হয়নি ওর। বাড়ীতেও খুব একটা থাকেনা।’

চায়ের দোকানে কেউ কেউ কখনো কখনো ইশারা করে ডেকে চা-বিস্কুট দেয়। তাতেই ওর খুব আনন্দ। খাবারের অপচয় একদম পছন্দ করেনা হায়দার। নাজিরপুর, হাগনাগাড়ী, থানারপাড়া, গমাখালী, নতিডাঙ্গার মানুষেরা বলছেন, আমরা সবাই যখন নিশ্চিন্তে ঘুমাই। আমাদেরই ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক গুলি ওকে ঘুমোতে দেয়না। বিনিময়ে কারও কাছে পয়সা নেয় না। যে যা দেয় তাই খায়। ওই তো সমাজ ও দেশের প্রকৃত সেবক। এলাকাবাসীরা ভালোবেসে তাকে জামা কাপড় দেয়। কামিয়ে দেয় চুল দাঁড়িও।

গমাখালী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাহাবুদ্দিন মণ্ডল বলছিলেন, ‘ও কোন স্কুলে পড়ে পরিবেশ সচেতনতার পাঠ নেয়নি। অথচ পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে যথেষ্টই সজাগ। ও দীর্ঘদিন অবহেলিত হয়ে এখানে ওখানে খেয়ে বেঁচে আছে। আমরা চাই ওর খাওয়া-পরার নূন্যতম প্রয়োজন মিটিয়ে ওকে সমাজ সেবার কাজে সঠিক ভাবে নিয়োগের ব্যবস্থা করুক প্রশাসন।’

কোন ঝাড়ু ছাড়াই দুই হাত দিয়েই যন্ত্রের গতিতে গ্রামের পর গ্রাম, রাস্তার পর রাস্তা পরিষ্কার করে ও। ‘কালা’ হায়দারের সারাটি দিন কাটে গ্রামের পথে পথে। কাছে গিয়ে কেউ কিছু বলতে চাইলে হাত নেড়ে মুখ ভেংচিয়ে অস্পষ্ট গোঙানিতে তার জমানো যত ক্ষোভ প্রকাশ করতে চায়। তার এই ক্ষোভ যেন দেশের সমস্ত প্লাস্টিকে উপর। প্লাস্টিক দূষণের হাত থেকে পরিবেশকে রক্ষা করতে স্রষ্টা যেন ওকে আর ছোট্ট পারিবারিক গন্ডির মধ্যে বেঁধে রাখতে চাননা। সংসার মায়ার পরিবর্তে যেন গোটা বিশ্ব নিখিলই তার নামে লিখে দিয়েছেন বিধাতা।

পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের করিমপুর বিজ্ঞান কেন্দ্রের সম্পাদক সমিত দত্ত টিডিএন বাংলাকে বলেন, ‘হায়দার বধির হলেও হয়তো শুনতে পায় মাটির কান্নার শব্দ। ওর প্লাস্টিক পুড়িয়ে ফেলার মাধ্যমে মৃত্তিকা দূষনের হাত থেকে কিছুটা হলেও পরিবেশ বেঁচে যাচ্ছে। আমরা তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ এই নিরক্ষর নির্লোভ ও আত্ম-সম্মানবোধ সম্পন্ন হায়দারের কাছেই বরং পরিবেশ শিক্ষাটা গ্রহন করার চেস্টা করতে পারি।’

Related Articles

Back to top button
error: