সাহিত্যসাহিত্য ও সংস্কৃতি

গল্পের নাম:- “রিজু বাঁচতে চেয়েছিলো” গল্পকার:-মোস্তফা কামাল (পর্ব-৮)

গল্পের নাম:- “রিজু বাঁচতে চেয়েছিলো”
গল্পকার:-মোস্তফা কামাল
(পর্ব-৮)

শীতের সকাল। কুয়াশাচ্ছন্ন মেঘের আড়াল থেকে সূর্যি মামা সবে দেখা দিয়েছে। ঐ সময় রিজু বাড়ির বাইরে এসে রোদ পোহাচ্ছিলো। মোটর বাইকে কোথা থেকে চারজন লোক এসে রিজুকে জিজ্ঞেস করলো, “এটা কি মিজানুর সাহেবের বাড়ি?”

—— হুম । কোথায় থেকে আসছেন?

——– সাগরপাড়া থেকে।

——- আপনার কে হোন?

——–আব্বা।

……… ও! উনাকে একটু ডেকে দেওয়া যাবে?

…….. আব্বা তো বাড়িতে নেই।

……. কোথায় গেছেন?

……… কোথাও যাননি। আশেপাশে হয়তো আছেন।

লোকগুলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে রিজুকে দেখতে লাগলেন। রিজুর মনে হলো উনারা যেন হাটে গরু কিনতে এসেছেন। স্বল্প মূল্যে রিজুকে কেনার জন্য পর্যবেক্ষণ করছেন।

বাবা বাড়ি এলেন। জানলেন, তারা বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন। বাবাকে উনারা প্রস্তাব দিয়েছেন, আপনার ছেলেকে আমাদের হাতে তুলে দিন। ওর ভবিষ্যত আমরাই দেখবো। আপনাকে একদম চিন্তা করতে হবে না।

…… না না। সেটা হয়না। আমি ধার দেনা করে চল্লিশ হাজার টাকা জোগাড় করে ফেলেছি। আর কিছু টাকা আমি আমার জমি বিক্রি করে জোগাড় করে নেবো। স্কুল আমাকে আরও একসপ্তাহ সময় দিয়েছে।আশা করি উক্ত সময়ের মধ্যে জোগাড় হয়ে যাবে।

…….. আপনি এটা বড়ো ভুল করবেন মৌলবি সাহেব। আপনার আরও সন্তান সন্ততি রয়েছে। শুধু একটা ছেলের জন্য কেন সবার হক নষ্ট করবেন?

……. এ ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই।

…… আছে। আমাদের উপর দায়িত্ব ছেড়ে দিন। আমরা সব দেখে নেবো। স্কুল কমিটি আমাদের খুব চেনা জানা। টাকা লাগলে আমরাই স্কুলকে টাকা দেবো। এমনও হতে পারে স্কুলকে আমরা ম্যানেজ করে নিলাম। ওসব আপনাকে দেখতে হবে না। শুধু আমাদের দশ ক্লাস পাশ মেয়ের সঙ্গে আপনার ছেলের বিয়ে দিতে হবে।

…….. এটা হয়না। আমি মৌলবি মানুষ। সর্বদা পণের বিরুদ্ধে কথা বলি। আপনার প্রস্তাব মেনে নিলে লোকে আমায় ভুল বুঝবে।

…… কেন ভুল বুঝবে? এটা তো পণ নয়! আপনি তো নিচ্ছেন না। তাছাড়া আমরা তো আপনার হাতে টাকা দিচ্ছি না। দিচ্ছি আমাদের প্রয়োজনে আমাদের স্কুলকে।

মিজানুর সাহেব এদিক ওদিক একবার তাকালেন। ক্ষণিক আকাশের দিকে চেয়ে কি যেন ভাবলেন। দূরে দাঁড়িয়ে রিজুর দিকে একবার করুণ চোখে চায়লেন। রিজু মাথা নাড়িয়ে বাবাকে ইশারায় না করে দেওয়ার অনুরোধ করলো। ছেলের আবেদনে বাবা সায় দিলেন না। তিনি কিছুক্ষণ ভেবে উনাদের প্রস্তাবে মত দিয়ে দিলেন। মেয়ে না দেখেই পাকাপাকি কথা হয়ে গেল।

রিজু কী করবে কিছুই বুঝতে পারেনা। তার মনের মধ্যে ঝড় বয়ে যায়। নিজেকেই প্রশ্ন করে, “এইভাবে বিয়ে করে তাকে শিক্ষক হতে হবে? তার শিক্ষার কি কোনো মূল্য নেই? তার আশা ভালোবাসা সব বিসর্জন দিতে হবে? এ কেমন চাকরি! এভাবে চাকরি পেলে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি তার দায়বদ্ধতা কতটুকু থাকবে? রি রি করে ওঠে রিজুর সমস্ত শরীর! ঘৃণা হয় স্কুল কমিটির এমন আচরণে! ঘৃণা আসে এমন সিস্টেমের বিরুদ্ধে! দম বন্ধ হয়ে আসে তার! কোনো কথা বলতে পারে না সে। উপায়ন্তর না দেখে তার হত ভাগ্য আর শালিনীর স্বপ্ন ভঙ্গের ছবি এঁকে নিজেকে অসহনীয় পরিস্থিতির কাছে সঁপে দেয়।

মেয়েটাকে রিজু দেখেনি। দেখার বা কী দরকার। সে তো স্বেচ্ছায় বিয়ে করছে না। সে যেমনই হোক তাকে মেনে নিতেই হবে। এটাই রিজুর নিয়তি। শালিনীর কথা ভাবতে গেলে ওর চাকরিটা হবে না। শালিনীর চেয়ে তার ভাই বোনেদের আশা আকাঙ্খা পূরণের স্বপ্ন তার মনের বেশির ভাগটাই দখল করে আছে। দারিদ্রতার মধ্যে সেই মনে শালিনীর ঠাঁই কম। বাবা মায়ের করুণ মুখ ভেসে ওঠে। তারাও তো রিজুর পথপানে চেয়ে আছে। রিজু চাকরি পেলে ওদের প্রত্যাশা গুলো পূরণ হবে। তারা কতইনা খুশি হবেন। তাদের সুখের জন্যই তো তার লেখা পড়া।

বাবা বললেন, ”শোনো রিজু, তোমার মেয়ে দেখার দরকার নেই।সব ঠিক আছে। ওরা বড়োলোক। আমাদের থেকে অনেক বড়ো। আমাদের ভাগ্য ভালো যে ওরা আমাদের বাড়িতে বিয়ে দিচ্ছেন। দিচ্ছেন শুধুমাত্র তোমাকে দেখেই।”

রিজু মন থেকে এসব কিছুই মেনে নিতে পারছে না। তার শুধু মনে হচ্ছে তার শিক্ষার কোনো দাম নেই! সে আজ পণ্য হতে চলেছে! বাবা মা, ভাই বোনদের সুখ স্বপ্নের কাছে তার পছন্দ-অপছন্দ, শিক্ষা-দীক্ষা সব বিক্রি হয়ে গেছে! বিক্রি হয়ে গেছে শালিনীর সব স্বপ্ন, আশা ভালবাসা!

রিজু ভাবে বাবা যা করছেন তার ভালোর জন্যই করছেন। তিনি খুশি হলেই হবে। হোক না নিজের বিসর্জন! কাঁদুক শালিনী! ও তো একজন হতভাগী! ওর জন্য রিজু কেন কষ্ট পাবে! না, শালিনী বলে সে কাউকে চেনে না! ঐ নামে সে কোনো মেয়েকে ভালবাসেনি কখনো! বুকটা হাহাকার করে ওঠে! দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়! পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয় রিজু। বিয়েতে সম্মতি দেয়। বাবা খুশি হোন।

রিজুর বন্ধুরা বলে,তুই যাকে বিয়ে করছিস, সারাজীবন যার দায়িত্ব তুই নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছিস তাকে একবার দেখা তোর দরকার। তাকে নিজের চোখে একবার দেখে আয়।

———– না রে, তার দরকার হবে না। আব্বা নিশ্চয়ই খারাপ কিছু করবেন না। তাছাড়া আমার পছন্দ অপছন্দের উপর বিয়েটা নির্ভর করছে না। আব্বা যেটা করবেন সেটাই ফাইনাল। আমার এখন চাকরি দরকার।

———-না রিজু ,এটা ঠিক বললিনা। চাকরি তোকে স্বাচ্ছন্দ্য দেবে ঠিকই কিন্তু বৌ তোকে সুখ দেবে এটা মনে রাখিস। শুধু বাপ-মা,ভাই-বোনদের কথা ভেবে নিজের সুখটাকে বিসর্জন দিয়ে তুই বাঁচবি কী করে? তাছাড়া মনের বিরুদ্ধে যাকে তুই ঘরে তুলবি তাকে কি তুই ভালবাসতে পারবি? আমরা জানি, পারবিনা। তাতে তোরও জীবন নষ্ট হবে আবার মেয়েটির জীবনও নষ্ট হবে। এভাবে তোর উপর চাপিয়ে দেওয়াটা আমরা মেনে নিতে পারছিনা রিজু।

চাপিয়ে দেওয়া বলছিস কেন তোরা? সবই তো বুঝতে পারছিস। আমি যে নিরুপায়!

তবুও বলছি একবার মেয়েটিকে দেখে আয়। যদি অপছন্দ হয়…………!

ঠিক আছে। আমি সাগরপাড়া স্কুল থেকেই মেয়েটিকে দেখে নেবো। কিন্তু তোরা জেনে রাখ আমার পছন্দ অপছন্দের কোনো দাম দেবেন না আব্বা। আব্বাকে তোরা চিনিস। উনি এক কথার মানুষ।

রিজু ভাঙ্গা সাইকেলটায় চেপে সাগরপাড়া হাই স্কুলের গেটে পৌঁছায়। এই স্কুলেই এগারো ক্লাসে পড়ে মেয়েটি। একটি ছাত্রের সাহায্যে তাকে আবিস্কার করে। শ্যাম বর্ণের মেয়েটির আলুথালু চুলগুলো কানের দুপাশ দিয়ে ঝুলছে। উস্কোখুস্কো দোহারা গঠন। সাধারণ মানের পোষাক। বুকের উপর দুটো বই চেপে ধরে হেলতে দুলতে বাইরে এসে ও বুঝে গিয়ে দৌড়ে পালায়।

রিজুর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। এ কী করেছেন বাবা! না না, এই বিয়ে হতে পারে না! মনটা ভেঙে যায় তার। পিতার প্রতি রাগ হয়। বাড়ি এসে রিজু মাকে বলে, ”আমি ঐ মেয়েকে বিয়ে করবো না মা। কিছুতেই করবোনা! কক্ষনো না!”

মা রিজুকে সান্ত্বনা দিতে পারেননি। উনি বাবাকে খুব ভয় করে চলেন। তার মতের বাইরে মায়ের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না। একসময় কথাটি বাবার কানে গেলো। তিনি শুনে কঠোরভাবে হুঁশিয়ারি দিয়ে বললেন, ”আমি কোনো কথাই শুনতে চাই না। আমার একটা সম্মান আছে। আমি ভদ্রলোককে কথা দিয়েছি। বিয়ে তোমাকে ওখানেই করতে হবে। না হলে আমি তোমাকে ত্যাজ্য পুত্র করতে বাধ্য হবো। তোমার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক থাকবেনা।”

মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করেন। রিজুর চোখ দুটো ভিজে যায়। তার মনে একটা প্রচন্ড রাগ এসে জড়ো হয়। মন চায় পিতার অবাধ্য হয়ে জোর প্রতিবাদ করে। কিন্তু পারেনা। বাধ্য হয় মেনে নিতে। তার ইচ্ছেগুলো খুন হয়। নিজের ইচ্ছেকে যদি খুন করা অপরাধ হতো তাহলে রিজু আজ নিজেই ফাঁসির আসামী হতো। রিজু জানে, বেশি বাড়াবাড়ি করলে বাবার বুকের ব্যথাটা বেড়ে যায়। বামদিকে ব্যথা হয়। ওর তখন খুব কষ্ট হয়। মা বুকে তেল মালিশ করেন আর বলেন, ”তোর আব্বাকে আঘাত দিসনা রিজু। দেখলি তো, তোর ব্যবহারের জন্য আজ তোর বাবার এই অবস্থা! তোর কাছ থেকে আঘাত পেয়ে বুকে ব্যথা উঠেছে।”

রিজু সেই রিস্ক নেয়নি। বাবার কষ্ট সে চায়না! হোকনা তার কষ্ট! কোনোদিন যখন তার ব্যথা বেদনা, চাওয়া পাওয়া বাবা বুঝতে চাননি তখন আজ আর বুঝবেন না। তিনি যা করছেন তার ভালোর জন্যই তো করছেন। রিজুর লেখাপড়া, তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনিই ভাবেন । সুতরাং তার মতামতকে প্রাধান্য দিতেই হবে। না হলে তাকে অসম্মান করা হবে ।

রিজু ভাবনার গহীনে ডুবে যায়।ভাবে, বাবার কথা রাখতে গিয়ে সে যাকে বিয়ে করবে শুধু শুধু তার জীবনটাই নষ্ট হবে। সারাজীবন সে নিজেও আগুনে পুড়বে। বাধ্য হয়ে সে হয়তো স্বামীর দায়িত্ব পালন করবে কিন্তু তাকে কোনোদিনই ভালোবাসতে পারবে না।

পরক্ষণেই সে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়। বিড়বিড় করে বলে,”আজকাল চাকরি পাওয়াটা খুব কঠিন। সুযোগ যখন এসেছে তখন তা গ্রহণ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। পরবর্তীতে চাকরি হবেই সেই ভরসা কে দেবে? এখন চাকরিটা হলে সংসারের অভাব অভিযোগ ঘুচবে। ছোট ভাই বোনদের ছোট্ট ছোট্ট আশা গুলো পূর্ণ হবে। আব্বা একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন।”

তবুও প্রত্যেক ছেলে বা মেয়ের বিয়ের আগে তাদের অনেক স্বপ্ন, কিছু চাওয়া পাওয়া থাকে। রিজুর মনে হয়, প্রত্যেক পিতা মাতার সন্তানের কিছু চাওয়া পাওয়াকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। অতি কষ্টে ছেলেকে মানুষ করার পর তার সুখ বিসর্জন দিয়ে যখন তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে অন্যের সাহায্য নিতে হয় তখন একজন পিতার কাছে সেটা কখনোই গৌরবের থাকে না।

রিজু নিরুপায়! আগামীকাল তার বিয়ে। একেবারেই অনাড়ম্বরে। রাতটা পার হলে স্নান খাওয়া সেরে সে আইনুল ও ছোট মামাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মা উঠোনে বসে খেজুরের পাতা দিয়ে পাটি বোনাতে বসেন। তার মুখ ভার। তিনি শোকাচ্ছন্ন।

রিজু বললো, “মা আসছি।” মা চুপ থাকলেন। আসলে মায়ের মনে তখন সাইক্লোন আছড়ে পড়েছে। বাড়ির বড়ো ছেলের এই ভাবে বিয়ে তিনি কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। রিজু চোখ দুটোকে রুমাল দিয়ে বারবার মুছে হালকা হতে চাইলো। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে শুধু আল্লাহকে বললো, “হে আমার আল্লাহ, এই ভাবে যেন আর কারো বিয়ে না হয়!”

বিষাদগ্রস্ত মায়ের সঙ্গে প্রকৃতিও আজ ভারাক্রান্ত। বাতাস যেন থমকে গিয়েছে। অদৃষ্টের অট্টহাসির মধ্যেই রিজু বেরিয়ে পড়লো।

Related Articles

Back to top button
error: