সম্পাদকীয়

সংশোধিত কৃষি আইন গরিব চাষির কফিনে শেষ পেরেক

মুহাম্মাদ নূরুদ্দীন, টিডিএন বাংলা: সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার কোন আলাপ-আলোচনা, বিতর্ক বিতণ্ডা, বিশ্লেষণ ছাড়াই একের পর এক বিল পাস করে চলেছে। দেশের সংবিধান, ঐতিহ্য, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, গণতান্ত্রিক পরিবেশ কোনকিছুকেই তোয়াক্কা না করে গায়ের জোরে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের মত এগিয়ে চলেছে কেন্দ্র। লকডাউনের অজুহাতে কেন্দ্রের আনা এক একটি বিল আঘাত হানছে দেশের গরীব জনগণের প্রতি। এইরকম একটি বিল নয়া কৃষি আইন এ পরিণত হল। এ আইন পাস হওয়ার পূর্বে বিস্তারিত আলোচনা করার কোন সুযোগ রাখা হয়নি। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বিশেষ পরামর্শ করা হয়েছে বলে মনে হয়না। গোটা দেশ জুড়ে কৃষক সমাজ এই বিলের বিরোধিতায় এখন রাস্তায় নেমেছে। সরকারের বক্তব্য সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে কৃষক সমাজকে ভুল বুঝাচ্ছে বিরোধীরা। এই বিল নাকি কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দাবি করেছেন এই বিল কৃষকদের অর্থনৈতিক অবস্থা বদলাবে। ভারতের কৃষক সমাজ উপকৃত হবে।

প্রকৃত ব্যাপারটা কী তাই? সংশোধিত কৃষি আইনে বেশ কয়েকটি বড় পরিবর্তন করা হয়েছে। এই পরিবর্তনের মূল লক্ষ্য কর্পোরেট সংস্থাগুলির হাতে দেশের কৃষি ব্যবস্থা তুলে দেওয়া। কৃষকদেরকে তাদের নিয়ন্ত্রণে চলতে বাধ্য করা। এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে গরীব কৃষক আর নিজের জমিতে কাজ করতে পারবে না। হয়তো তার নিজের জমি থাকা সত্ত্বেও কোনো কর্পোরেট সংস্থার অধীনে তাকে কাজ করতে হবে।
সরকার মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস (এম এস পি) বা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে । এই নিয়ম চলে আসছে বহুদিন থেকে। ষাটের দশকের গোড়ায় কৃষক সমাজকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে এই আইন পাশ করা হয়েছিল। ভারতে প্রায় ২৫০০ ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে কৃষকের পণ্য খরিদ করার কেন্দ্র আছে। এই কেন্দ্রগুলিতে কৃষকরা তাদের ফসল বিক্রি করলে সরকার নির্ধারিত দামে তা খরিদ করে। এর ফলে কৃষকরা ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যায়। বাজারমূল্য অনুযায়ী কৃষকের দাম ঠিক করার জন্য সরকার নির্ধারিত কমিটি তৈরি করে দেয়। সামগ্রিকভাবে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করাই এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু এখন সেই আইন তুলে দেওয়া হচ্ছে।ফল সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে দেশের গরীব কৃষকরা।
কেন্দ্রীয় সরকার নতুন আইন মেনে চুক্তি চাষের উপর গুরুত্ব আরোপ করছে। অর্থাৎ গরিব কৃষকরা বড় বড় কর্পোরেট হাউসের সঙ্গে চুক্তির বিনিময়ে চাষ করবে। আমরা জানি আমাদের দেশের দাদন ব্যবস্থায় জর্জরিত কৃষকদের অবস্থার কথা। প্রথমত এই চুক্তি হবে গরিব অশিক্ষিত দুর্বল কৃষকদের সঙ্গে কর্পোরেট সংস্থার। স্বাভাবিকভাবেই গরিব চাষিদের ঠকানোর জন্য সব ধরনের সুযোগ তারা গ্রহণ করবে। সে ক্ষেত্রে চুক্তির মারপ্যাঁচ বোঝার ক্ষমতা গরিব চাষিদের কতটুকু থাকবে তা বলা মুশকিল। তাছাড়া চুক্তিভিত্তিক চাষের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হলে গরিব চাষির পাশে কে দাঁড়াবে? সরকার সে ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই দাঁড়াবে না। তাহলে তাদের হয়ে লড়াই করবে কে? কোন ক্ষেত্রে বিবাদ যদি আদালত পর্যন্ত গড়ায় তাহলে যাদের আদালত কিনে নেওয়ার ক্ষমতা আছে তাদের সঙ্গে গরিব চাষি লড়বে কীভাবে? আমরা ভারতের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে বর্তমান যে অবস্থা দেখছি তাতে সাধারণ মানুষের বিচার পাওয়ার সুবিচার পাওয়ার দিন শেষ হয়ে আসছে। সেই অবস্থায় চুক্তিভিত্তিক চাষ গরীব চাষিদেরকে কীভাবে রক্ষা করবে? এছাড়া চুক্তির যাঁতাকলে গরিব চাষিদেরকে একবার বেঁধে ফেলতে পারলে সেই সুদখোর মহাজনদের মত চক্রবৃদ্ধি হারে তাদের জমি-জিরেত বাড়ি সবকিছু গ্রাস করে নেওয়ার পথ সুগম হবে। এই বিলে সরকার সেই সুযোগ করে দিতে চেয়েছে। অর্থাৎ এক কথায় এদেশের ক্ষুদ্র চাষীদের অস্তিত্ব নির্মূল করে দেওয়ার জন্য তাদের কফিনে শেষ পেরেক টুকু গেঁথে দেওয়া হল। এখন থেকে গোটা দেশ হবে হাতেগোনা কয়েকজন কর্পোরেট মালিকের জমিদারি। আর সাধারণ গরিব কৃষক শ্রমিক হবে তাদের দাস। তারা যা খুশি তাই করতে পারবে। এই আইনে সেই ধরনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

(লেখক প্রবীন সাংবাদিক,বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও বহু শিশু পাঠ্য গ্রন্থের রচয়িতা)

Related Articles

Back to top button
error: