শিক্ষা ও স্বাস্থ্য

মৃগী রোগ ও তার নিরাময়

বিশেষ প্রতিবেদন, টিডিএন বাংলা: আমাদের সমাজের কমবেশি সকলেই মৃগী রোগ বা খিচুনি এই রোগের ব্যাপারে ছোট থেকে শুনে এসেছি। আর আমাদের মধ্যে একটা বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে যে এই রোগের কোন প্রতিকার নেই। অথচ এই ধারণা ভুল। এমনকি শিক্ষিতরাও অনেকে মনে করেন এই রোগের চিকিৎসা নেই! এমনকি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই রোগ নিয়ে বিভিন্ন কুসংস্কারও রয়েছে। মৃগী উঠলে অনেকে চামড়ার জুতার ঘ্রাণ শুকায়, মুখে চামচ বা পয়সা দিয়ে থামানোর চেষ্টা করে ইত্যাদি।

অথচ, মৃগী বা খিচুনী একটি নিরাময়যোগ্য রোগ। এর চিকিৎসা আছে। যথাযথ চিকিৎসায় এটি সম্পূর্ণ আরোগ্য হতে পারে। সময়মত চিকিৎসা করানো হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি ভালো হয়। এমনকি শুধু ওষুধেই বেশিরভাগ আরোগ্য হয়, সার্জারী লাগে না। সময়মত চিকিৎসা না করালে পঙ্গত্ব বা স্থায়ী সমস্যা তৈরী হয়।

হঠাৎ করেই শরীরে কাপুঁনি উঠে কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এটাকেই সাধারণত খিচুনী বা মৃগী বলা হয়। ইংরেজীতে বলা হয় Epilepsy (এপিলেপ্সি)। এটা একদম কম সময় (দু’চার সেকেন্ড) এর জন্যও হতে পারে।

তবে এ রোগ অন্য ভাবেও প্রকাশ পেতে পারে। যেমন- একটা আঙুল কাঁপতে থাকা, সবসময় হাসতে থাকা, বাচ্চাদের হঠাৎ কথা বলা কমে যাওয়া ইত্যাদি। যা আমরা অনেক সময় দুষ্টামি শয়তানি বলে উড়িয়ে দেই!

সোজা কথায় বললে, এটা মূলত একটা স্নায়ুবিক রোগ, ব্রেইনের রোগ, মাথার সমস্যা। আমাদের ব্রেইনে এক ধরনের বিদ্যুৎ সিস্টেম কাজ করে। ধরেন, স্বাভাবিক ইলেকট্রিসিটি হওয়ার কথা ৫০-৭০ ভোল্ট। সেখানে আপনার ব্রেইনে ২০০ ভোল্ট হয়ে গেল। তখন ব্রেইনের ইলেকট্রিসিটি বেলাইনে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। ফলে ব্রেইনের কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়, ব্রেইন শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায়। তখনই প্রকাশ পায় এই অস্বাভাবিক আচরণ, কাপুঁনি বা খিচুনী যাকে আমরা মৃগী বলছি।

এ রোগে ডাক্তাররা সাধারণত দু’টি টেস্ট করে থাকেন। একটি হচ্ছে ব্রেইনের Magnetic resonance imaging (MRI). বলতে পারেন X-Ray এর মত। এর মাধ্যমে পুরো ব্রেইনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশের স্পষ্ট ছবি দেখা সম্ভব হয়।
আরেকটি হচ্ছে electroencephalogram (EEG). বলতে পারেন হার্টের ECG টেস্টের মত। ব্রেইনের কোন অংশে কি লেভেলে ইলেকট্রিকেল একটিভিটি বা সমস্যা হচ্ছে তা এ টেস্টে বুঝা যায়। এই টেস্ট বেশ সময় লাগে। ২০-৪৫ মিনিট ধরে চলে। তবে Long EEG হলে ৬ ঘন্টা ধরেও চলতে পারে। অনেকে ভয় পায়। ভয় পাওয়ার কিছু নাই। এর তেমন সাইড ইফেক্ট নাই। আপনার ডাক্তার সেসব বুঝেই টেস্ট করাবেন।

প্রয়োজন অনুযায়ী এ দু’টির বাইরেও টেস্ট লাগতে পারে। তবে এ রোগের উৎস নির্ণয়ে EEG টেস্ট বেশ ভালো হেল্প করে। খিচুনীর লেভেল আর ধরনের উপর নির্ভর করে ডাক্তারদের চিকিৎসায়ও পরিবর্তন আসে।
এটা বেশি দেখা যায় বাচ্চাদের, তবে বড়দেরও কম না। অনেকের শিশুকালে ছিল না, বড় হয়ে হঠাৎ দেখা দিয়েছে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অনেক সময় বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের ঘাটতির কারণেও এরকম হতে পারে। সেটা একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারই ভালো বলতে পারবেন।

খিচুনী বা মৃগী দেখা দিলে কি করবেনঃ

. আতঙ্কিত হবেন না।
. মাথার নীচে নরম বালিশ দিয়ে রোগীকে এককাৎ করে শুইয়ে দিন এবং সময়গনণা শুরু করুন।
. রোগী যাতে পরে বা অন্য কোনভাবে বিশেষ করে মাথায় আঘাত না পায় সে দিকে লক্ষ্য রাখুন।
. কোনভাবেই থামানোর চেষ্টা করবেন না। মুখে চামচ, পয়সা বা জুতা ইত্যাদি কোন কিছু দিবেন না। মনে রাখবেন, থামানোর চেষ্টা করলে উল্টো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
. সাধারণত এমনিতেই কিছু সময় পর খিচুনী থেমে যায়। থেমে গেলে সময় দেখুন, কত মিনিট বা কত সেকেন্ড ছিল। চিকিৎসার জন্য সময়ের হিসাবটা কাজে লাগবে।
. তবে ৫ মিনিটের বেশি হলে তাৎক্ষণিক ডাক্তারের নিকট নিয়ে যান।

থামার পরে এ সম্পর্কে রোগীকে কিছু জিজ্ঞাসা করে লাভ নাই। সাধারণত এ সময়টার কিছু রোগী মনে করতে পারেন না।
যদি প্রথমবার এ সমস্যা দেখা দেয় বা আগে ডাক্তার না দেখিয়ে থাকেন, তবে অবশ্যই আপনি হাসপাতালে যাবেন। ডাক্তার দেখাবেন এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা করাবেন। রোগীর মৃগী অবস্থার কোন ভিডিও দেখাতে পারলে ডাক্তারের জন্য সুবিধা হয়।

আগেই বলা হয়েছে এটি ব্রেইনের একটি রোগ। তাই এ রোগের কার্যকরী চিকিৎসার জন্য আপনাকে যেতে হবে ব্রেইনের ডাক্তারের নিকট। মানে একজন নিউরোলজি বিশেষজ্ঞের নিকট। শিশুদেরকে দেখাবেন পেডিয়াট্রিক নিউরোলজিস্ট বা শিশু স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ।

সরকারীভাবে, দেশের প্রায় সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই নিউরোলজি বা শিশু নিউরোলজি বিভাগ রয়েছে।তবে এ রোগের চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ। কোনক্রমেই আপনার ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত এ রোগের ওষুধ বন্ধ করবেন না। এ রোগে হঠাৎ ওষুধ বন্ধ করলে আপনার বড় ক্ষতি হতে পারে। বরং ওষুধ বন্ধ করতে চাইলে ডাক্তারকে বলুন। তিনি পর্যায়ক্রমিকভাবে ডোজ কমিয়ে ওষুধ নেয়া বন্ধ করার সুযোগ করে দেবেন।

Related Articles

Back to top button
error: