আব্দুস সালাম
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন কর্তৃক ‘বঙ্গভঙ্গের’ ঘোষণার পরপরই বাংলা তথা ভারত জুড়ে শুরু হয় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন। আর এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে শুরু হয় স্বরাজ ও স্বদেশী আন্দোলন। কিন্তু এক শ্রেনির বিপ্লবী আন্দোলনের এই ধারার উপর আস্থা রাখতে পারছিলেন না। তারা মনে করেন এইভাবে সাফল্য আসবে না বরং সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে বাধ্য করতে হবে। এই চিন্তা থেকেই তৈরি হয় বেশ কিছু গুপ্ত সমিতি। এছাড়া ইতিপূর্বে তৈরি গুপ্ত সমিতিগুলি এর সঙ্গে মিলিত হয়ে বাংলা জুড়ে শুরু করে গুপ্ত হামলা ও গুপ্তহত্যা। আর তাদের এই কাজে উৎসাহ যোগায় বাংলার কিছু পত্রিকা। “একটি সংবাদপত্র এতদূর পর্যন্ত বলে যে মুসলিম গুন্ডাদেরকে এবং তাদের সাহায্যকারী সরকারি কর্মচারীদেরকে জীবন্ত দগ্ধ করলেও হিন্দুসমাজের প্রতিশোধ গ্রহণ যথেষ্ট হবে না।” (খান-ইন্ডিয়া টুডে, পৃঃ ৮৭; আব্দুল হামিদ-মুসলিম ইন ইন্ডিয়া, পৃঃ ৬১)
আর এক পত্রিকা ‘যুগান্তর’ ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ৩০ মে বঙ্গ বিভাজনে সমর্থনকারীদের বিরুদ্ধে বলে, “মা জননী পিপাসার্ত হয়ে নিজ সন্তানকে জিজ্ঞেস করছে একমাত্র কোন বস্তু তার পিপাসা নিবারণ করতে পারে। মানুষের রক্ত এবং ছিন্ন মস্তক ব্যতীত অন্য কিছুই তাকে শান্ত করতে পারে না। অতএব জননীর সন্তানদের উচিত মায়ের পূজা করা এবং তার স্পিত বস্তু দিয়ে সন্তুষ্টি বিধান করা। এসব হাসিল করতে যদি নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে হয় তবুও পশ্চাৎপদ হওয়া উচিত হবে না। যেদিন গ্রামে গ্রামে এমনিভাবে মায়ের পূজা করা হবে সেদিনই ভারতবাসী স্বর্গীয় শক্তি ও আশীর্বাদে অভিষিক্ত হবে।” ( ইবনে রায়হান–বঙ্গভঙ্গের ইতিহাস, পৃঃ ৬-৭)
বঙ্গভঙ্গ পাকাপোক্ত হলে ১৯০৪ খ্রিঃ লন্ডন থেকে ভারতে ফিরে আসেন বিপ্লববাদী নেতা বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, পরের বছরই আসেন তাঁর ভাই অরবিন্দ ঘোষ। বঙ্গ জুড়ে শুরু হয়ে যায় গুপ্তহত্যা ও গুপ্ত হামলার পালা। পূর্ববঙ্গে এর নেতৃত্বদেন পুলিন দাস ও প্রতুল গাঙ্গুলী। বিভিন্ন নামে বাংলা জুড়ে শুরু হয় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প, যেখানে বোমা বাঁধা ও আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল সরকারি অফিস-আদালত ও ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের ওপর হামলা চালিয়ে সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলা। তবে ইংরেজ সরকারের পাশাপাশি মুসলিম নেতৃত্বও এই হামলার শিকার হন। অন্যতম মুসলিম মুখ নবাব সলিমুল্লাহকে কুমিল্লার জনসভায় আক্রমণ করা হয়। এরপর রাজগঞ্জের রাস্তা অতিক্রম কালে তাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। এই হামলায় তিনি বেঁচে যান কিন্তু সাঈদ নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়। এরপর ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু সরকারি উকিল আশুতোষ বিশ্বাসকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডি এস পি শামসুল আলমকে হত্যা করা হয়। এছাড়া বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরকে ৪ বার আক্রমণ করা হয়। ১৯০৭ খ্রিঃ ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এলেনের উপর হাতবোমা নিক্ষেপ করে হত্যার চেষ্টা করা হয়। (বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, পৃঃ ৩৩০)
১৯০৬ খ্রিঃ বারীন ঘোষ ও ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত পূর্ববাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর বামফিল্ড ফুলার ও গভর্নর স্যার এন্ড্রু ফ্রেজারকে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ১৯০৭ খ্রিঃ চন্দননগরে মেয়র তাদ্দিভেলের বাড়িতে বোমা নিক্ষেপ করা হয়। একই বছর কুষ্টিয়ার পাদ্রী হিকেন বেথমকে গুলি করা হয়। বিহারের মোজঃফরপুরে ১৯০৮ খ্রিঃ ৩০ এপ্রিল ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী ম্যজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে গিয়ে ভুল বশতঃ মিসেস কেনেডি ও তার কন্যাকে হত্যা করে বসে। ১৯০৮ খ্রিঃ আলিপুর মামলায় গোঁসাই নামের জনৈক বিপ্লবী রাজ- স্বাক্ষি হলে কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন্দ্র বসু জেলের মধ্যে গোঁসাইকে হত্যা করেন। এই সময় বাংলার প্রধান গুপ্ত সমিতি ছিল অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর সমিতি। এছাড়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গুপ্ত সমিতি গুলো হল- ময়মনসিংহের সাধনা ও সুহৃদ সমিতি, ফরিদপুরের ব্রতী সমিতি, ঢাকার সংঘ সমিতি প্রভৃতি। (ভারতের ইতিহাস ও স্বাধীনতা সংগ্রাম-তুলসীর,পৃঃ ১৪৪)
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই গুপ্ত সমিতি গুলিতে মুসলিমদের ভূমিকা কেমন ছিল, তারা কি এ কাজে অংশ নিয়েছিলেন? ব্যতিক্রমী কয়েকজন ছাড়া মুসলিমরা এই সমিতি গুলোতে অংশগ্রহণ করেননি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে কেন মুসলিমরা এই সমিতিগুলি থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন, তারা কি দেশকে ভালোবাসো না বা তারা কি শহীদ হওয়ার মতো সাহসী ছিলেন না?
মুসলিমরা মূলতঃ দুটি কারণে গুপ্ত সমিতি গুলি থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিল। এক– ১৯০৫ থেকে ১৯১১খ্রিঃ পর্যন্ত গুপ্ত সমিতি গুলির মূল লক্ষ্য ছিল বঙ্গভঙ্গ রদে সরকারকে বাধ্য করা। অন্যদিকে বঙ্গভঙ্গের ফলে মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গের মানুষ নতুন আসা দেখছিল। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে আর্থিক বরাদ্দ বৃদ্ধি পায় এবং প্রশাসনিক জটিলতা কমায় কাজের সুবিধা হয়। এছাড়া পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ জমির মালিক ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু জমিদার শ্রেনি। বঙ্গভঙ্গের ফলে তারা হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ হলে সেই সব আশা ও স্বপ্ন ভেঙে যাবে। ঠিক এই কারণেই মুসলিমরা এ সমস্ত গুপ্ত সমিতিগুলি থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। (বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, পৃঃ ৩৩০-৩৩২)
এ বিষয়ে মাওলানা আযাদের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য, তিনি বলেন, “বিপ্লববাদী দলগুলি মধ্যবিত্ত হিন্দু সমাজ থেকে গৃহীত হত। বস্তুতঃ প্রত্যেকটি বিপ্লববাদী দল ছিল কার্যকরীভাবে মুসলিমবিরোধী।” (ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম, পৃঃ ৫) বামপন্থী লেখক গোপাল হালদারের মতে, “বৈপ্লবিক সন্ত্রাসবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ব্যর্থ হয়ে ছিল আর তা হল এই যে তারা সক্রিয় মুসলিম সমর্থন লাভ করতে পারেনি।” (স্টাডিজ ইন বেঙ্গল রেনেসাঁ, পৃঃ২৫৭)
দুই, এই সমিতিগুলির সমস্ত বিশ্বাস ও কর্মকান্ড ছিল হিন্দুধর্ম কেন্দ্রিক। এখানে দীক্ষা নিতে গেলে হিন্দু রীতিনীতি মেনেই দীক্ষা নিতে হতো। ফলে মুসলিমদের পক্ষে কখনই এই সমিতিগুলিতে যোগ দেওয়া সম্ভব ছিল না। এ প্রসঙ্গে লেখক গিরিজাশংকর রায়চৌধুরী বলেন,” তিনি এক পায়ে দাঁড়াইয়া বগলা মন্ত্র জপ ও বগলা মূর্তিপূজা শেষ করিয়া আসিয়াছেন। অতি প্রত্যুষে স্নান করিয়া চণ্ডীপাঠ সমাপন করিয়া তিনি এখন গীতা পাঠ আরম্ভ করিয়াছেন। একহাতে গীতা আর এক হাতে তলোয়ার দিয়ে তিনি অন্ধকারের গুপ্ত সমিতিতে হেমচন্দ্র কানুনগোকে ইতিপূর্বে বরোদা হইতে বাংলাদেশ আসিয়া দীক্ষা পর্যন্ত দিয়েছেন।… এতে মুসলিম ভ্রাতাগণ যদি বলেন যে, এ অবস্থায় দেশ উদ্ধারের জন্য আমরা যাইবা কি করিয়া আর থাকি বা কোন মুখে? আমাদের তো একটা পৃথক ধর্ম ও তার অনুশাসন আছে…” (শ্রী অরবিন্দ ঘোষ ও বাংলায় স্বদেশী যুগ, পৃঃ ৪৫২-৪৫৩)
এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে যে, কোনো লক্ষ্য অর্জনের জন্য গুপ্ত হামলা ও গুপ্তহত্যা কি সমর্থনযোগ্য? এ প্রশ্নের উত্তরে প্রথম সারির ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মন্তব্য সর্বাধিক প্রণিধানযোগ্য। এ সম্পর্কে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এনার্কিস্টদের (সন্ত্রাসবাদীদের) প্রতি কারো কোনো সহানুভূতি থাকতে পারেনা। নরহত্যা নরহত্যাই কার্যটিকে যে নাম দিয়েই হোক গ্রহণীয় করার অথবা যে কোন উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই মার্জনা করবার চেষ্টা করা হোক না কেন।”(এ নেশন ইন মেকিং,পৃঃ ২৩৪) এ প্রসঙ্গে লোকমান্য তিলকের মন্তব্য হচ্ছে, “…আমার বলতে দ্বিধা নেই যে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে যে সকল হিংসাত্মক কার্যাবলী সংঘটিত হয়েছে সেগুলি শুধু আমার কাছে বিতৃষ্ণাসূচকই নয় পরন্তু আমার মতে বাস্তবক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যবশতঃ আমাদের রাজনৈতিক অগ্রগতির প্রসারকে যথেষ্ট রূপে ব্যাহত করছে। আগে যেমন বহুবার বলেছি ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গিতে হোক বা সর্বসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গিতে এসবই সমানভাবে নিন্দনীয়।” (লাইফ অব বি.জি.তিলক ডি.পি কর্মকার, পৃঃ ২৪৪)
এমনকি স্বয়ং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ফরাসি মনীষী রম্যাঁ রোলাঁর কাছে স্বীকার করেছিলেন যে, “সন্ত্রাসবাদ কখনোই সুস্থ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়।”
তথ্য সূত্র–
১) বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস–আব্বাস আলী খান
২) স্বাধীনতার ফাঁকি– বিমলানন্দ শাসমল, ৩) ভারতের ইতিহাস ও স্বাধীনতা সংগ্রাম– তুলসীর