অক্টোপাসের করাল গ্ৰাসে বিপন্ন লাক্ষাদ্বীপ
![](https://bangla.tdnworld.com/wp-content/uploads/2021/06/LAKSHADWEEP.jpg)
আব্দুস সালাম, টিডিএন বাংলা : ভারতবর্ষের মূল ভুখন্ড থেকে প্রায় ২০০ -৪৪০ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে লাক্ষা সাগরের মালাবার উপকূলে অবস্থিত অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা একটি কেন্দ্র শাষিত অঞ্চল হল লাক্ষাদ্বীপ। অসংখ্য প্রবালকীটের দেহাবশেষ সঞ্চিত হয়ে এটি গড়ে ওঠায় একে প্রবালদ্বীপও বলা হয়। ৩২ বর্গ কিমি. এই দ্বীপপুঞ্জের রাজধানীর নাম কাভারাত্তি। এটি একটি জেলা এবং ১০টি মহাকুমা নিয়ে গঠিত। প্রায় সত্তর হাজার(৭০০০০) মানুষের বাস। মুসলিম অধ্যুষিত (৯৬.৫৮ শতাংশ) এই দ্বীপপুঞ্জের প্রধান ভাষা মালায়লাম। আগাটি দ্বীপের কোচি বিমানবন্দরের এবং কেরালার বেপার পোর্ট দ্বারা এটি ভারতের মূল ভূখন্ডের সাথে যুক্ত।
এটি সভ্য সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় আমাদের সমাজের হীংস্রতা , দুর্ণীতি পরায়ণতা, অসামাজিক কার্যকলাপ এই দ্বীপপুঞ্জটিকে সেভাবে স্পর্শ করতে পারেনি। এনসিআরবি (NCRB)’এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী লাক্ষাদ্বীপের ক্রাইম ও ক্রিমিনালের সংখ্যা দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। এখানকার জেলখানা গুলি প্রায় শূন্যই পড়ে থাকে। তাই বলা যায় অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো না হলেও এই দ্বীপপুঞ্জের সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকায় মানুষ শান্তিপূর্ণ জীবন-যাপন করে। কিন্তু কিছু দিন ধরেই অজ্ঞাত এক শ্রেনির মানুষ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই দ্বীপপুঞ্জে সামাজিক অস্থিতিশীলতা তৈরীর চেষ্টা করছে। হঠাৎ করেই যেন এখানে ক্রাইম বেড়ে যাচ্ছে, যা এখানকার ইতিহাসে খুবই অস্বাভাবিক। অজ্ঞাত মহলের উস্কানিতে সাম্প্রদায়িক হিংসা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে বর্তমান প্রশাসক প্রফুল্ল প্যাটেল ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে একের পর এক বিতর্কিত নীতি গ্রহণ করছেন, যা লাক্ষাদ্বীপের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার নির্লজ্জ্ব প্রয়াস। কেরালার সিপিএম সাংসদ ইলামারাম করিম তাঁর চিঠিতে অভিযোগ করেন, প্যাটেল প্রশাসন দায়িত্ব পাওয়ার পর সুকৌশলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সরিয়ে গুজরাটি বেনিয়াদের বসাতে শুরু করেছেন। ‘রিফর্ম ও ডেভেলপমেন্ট’ এর নামে সেখানকার পরিবেশ, সংস্কৃতি ও ভূ-প্রকৃতি ধ্বংস করে সেখানে গুজরাটি রিয়েল স্টেট ব্যাবসায়ীদের অবৈধ নির্মাণের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে, যা এখানকার বাস্তুতন্ত্রকে চরম হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
প্রফুল্ল প্যাটেল দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই এখানে অসংখ্য মদের দোকানের লাইসেন্স দিয়েছেন। পশু সংরক্ষণ আইনের নামে এখানে গোমাংস খাওয়া ও তার ব্যবসা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এমনকি গোমাংস ভক্ষণ বা এর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকলে ৭-১০ বছরের জেল এবং জরিমানা করা হবে। অথচ এখানকার প্রায় ৯৭ শতাংশ মানুষ মুসলিম। তাছাড়া এখানকার একটি বৃহৎ শ্রেনির মানুষ গরুর ফার্মেসি এবং দুগ্ধ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত । কিন্তু এই ব্যবসা বন্ধ করে অসংখ্য মানুষকে কর্মহীন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে।
প্যাটেল প্রশাসনের ক্ষমতা গ্ৰহণের আগে এখানে করোনার প্রভাব ছিল না বললেই চলে । কিন্তু তাঁর প্রশাসনের দায়িত্ব জ্ঞানহীন ভুল পদক্ষেপের ফলে বর্তমানে সেখানে করোনা রোগীর সংখ্যা ৬৬১১ টি , যা জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশেরও বেশি।
লাক্ষাদ্বীপের বাসিন্দাদের প্রধান জীবিকা হল মৎস শিকার ও মৎস ব্যাবসা। কিন্তু প্যাটেল প্রশাসন উপকূল রক্ষা আইনের আওতায় উপকূলের মৎস্যজীবীদের কুঁড়েঘর ভেঙে দিচ্ছে এবং এই জীবিকা বন্ধের ষড়যন্ত্র করছে।স্থানীয় সাংসদ মহম্মদ ফয়সাল বলেন,”লাক্ষাদ্বীপ উন্নয়ন আইনের মূল লক্ষ্য হল, দেদার জমি অধিগ্ৰহণ।” এখানকার রাস্তাগুলোকে নাকি জাতীয় সড়কের মত করা হবে। লাক্ষাদ্বীপের বড়ো বড়ো সড়কের কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে!”
এছাড়া লাক্ষাদ্বীপের সঙ্গে কেরালার ধর্মীয় সম্পর্ক বহু প্রাচীন। এতদিন কেরালার বেপার পোর্টের মাধ্যমে এই দ্বীপপুঞ্জের সাথে বহিঃর্বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্য চলতো । কিন্তু এখন বিজেপি শাষিত কর্নাটকের ম্যাঙ্গালুরুর মাধ্যমে তা চলছে। এ প্রসঙ্গে কেরালার মূখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন বলেন, ‘লাক্ষাদ্বীপের সঙ্গে কেরালার সম্পর্ক বহু প্রাচীন। কিন্তু বর্তমান প্রশাসন সেটাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। প্রশাসনের সিদ্ধান্ত সেখানকার মানুষের জীবনযাপন দুর্বিষহ করে তুলছে।’ সিপিএম-এর রাজ্যসভার সাংসদ ইলামারাম করিম তাঁর চিঠিতে লেখেন, ‘কেরালার বেইপুর বন্দরটি বহুদিন ধরেই কেরালা ও দ্বীপবাসিদের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করছিল। প্যাটেল প্রশাসন সেটা বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে।’
লাক্ষাদ্বীপের একমাত্র সাংসদ মহম্মদ ফয়জাল জানিয়েছেন যে, এই পর্যন্ত প্রায় ৩০০ সরকারি কর্মী কর্মচ্যুত হয়েছেন। অভিযোগ, উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবেই বিগত ছয় মাসে প্রায় দুই হাজার অস্থায়ী সরকারি কর্মচারীকে তাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বেই বরখাস্ত করা হয়েছে। প্রশাসন শিশু ও গর্ভবতী মহিলাদের পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করার ৩৮ টি অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে । জানা যাচ্ছে, প্রশাসনের নির্দেশে পর্যটন বিভাগের প্রায় ১০৯ জন কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণের পরেই তিনি এই দ্বীপে গুন্ডা আইন(Goonda Act) লাগু করেন। অথচ এনসিআরবি (NCRB)’ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী লাক্ষাদ্বীপে ক্রাইম এবং ক্রিমিনাল উভয়ের সংখ্যাই ভারতে সর্বনিম্ন। এই Goondas Act এর সবথেকে ভয়াবহ বিষয় হলো preventive Detention অর্থাৎ, যেখানে কোনো কোর্ট ট্রায়াল ছাড়াই যে কাউকে গ্রেফতার করা যেতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ খ্রি: ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের দমণ পীড়নের জন্য ‘রাউলাট আইন’ প্রনয়ণ করে। এ যেন আবার ব্রিটিশ জমানা ফিরে এসেছে।
লাক্ষাদ্বীপ ডেভেলপমেন্ট অথোরিটি রেগুলেশন ২০২১ এর প্রস্তাবিত খসড়াতে ,পঞ্চায়েত নির্বাচনে লড়াই করার জন্য নতুন আইন বানানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে যোগ্যতা হিসাবে বলা হয়েছে – যাদের সন্তানের সংখ্যা ২ এর বেশি তারা কেউ প্রার্থী হতে পারবেন না। অথচ, বিজেপির ৩০৩ জন সাংসদ সদস্যদের মধ্যে ৯৬ জনেরই দুইয়ের অধিক সন্তান আছে। এই আইনের ফলে অধিকাংশ প্রার্থীর প্রার্থী পদ বাতিল হবে।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, মাছ এবং পশু সংরক্ষণ সহ যেসমস্ত গুরুত্বপূর্ণ দফতর গুলো এতদিন পর্যন্ত জেলা পঞ্চায়েতের আওতায় ছিল, সেগুলো জেলা পঞ্চায়েতের আওতার বাইরে করে দেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকার এবং তার সমস্ত প্রশাসনিক শাখাকে লাক্ষাদ্বীপবাসীর জমির মালিকানা গ্রহণ এবং তার ব্যবহারে সরাসরি ও অবাধ হস্তক্ষেপের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী, অধিগ্রহণ করা জমি সরকার জমির মালিকের অনুমতি ছাড়াই ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারবে। এছাড়া এই অধিগৃহীত জমি কোন কাজে ব্যবহার হবে এক্ষেত্রে অস্পষ্টতা রাখা হয়েছে । ফলে এই আইনের অপব্যবহারের আশংকা থেকে যায়। পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া এই দমন-পীড়নমূলক আইনের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের আহ্বান জানিয়েছে। অভিনেতা ও পরিচালক গিতু মহনদাস এই সমস্ত বিতর্কিত আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। ফুটবলার সি.কে ভিনিথ এই খসড়া আইনের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছেন। ইতিমধ্যে সোশালমিডিয়াতে লাক্ষাদ্বীপের পক্ষে # SaveLakshadwwp এই ট্রেন্ড শুরু হয়েছে। বহু বিশিষ্টজন এই আইনের বিরোধীতা করে এটি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য যে নরেন্দ্র মোদীর মূখ্যমন্ত্রীত্বের আমলে প্রফুল্ল প্যাটেল ছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আইপিএস অফিসার দিনেশ্বর শর্মার মৃত্যুর পর অমিত শাহের ঘনিষ্ঠ প্রফুল্ল প্যাটেল’কে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসক করা হয়। এর আগে তিনি ২০১৬ সালে দমন ও দিউ এবং দাদরা ও নগর হাভেলীর প্রশাসক ছিলেন। দাদরা ও নগর হাভেলীর স্বতন্ত্র সাংসদ মোহন দেলকারের আত্মহত্যায় তার নাম জড়ায়। মোহন দেলকারের ১৫ পৃষ্টার সুইসাইড নোটে প্যাটেলের নামও ছিল। তিনি ফেসবুকে এবং সাংসদেও অভিযোগ করেন তাঁকে সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার জন্য প্রফুল্ল প্যাটেল চাপ দিচ্ছিল। এমনকি তার কাছ থেকে ২৫ কোটি টাকা তোলা চাওয়া হয়।