উপসম্পাদকীয়

মিরাট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হাসিমপুরা গনহত্যা : গনতান্ত্রিক ভারতের এক কলঙ্কজনক অধ‍্যায়

আব্দুস সালাম, টিডিএন বাংলা :১৯৮৭ সালের ১৪ই এপ্রিল নওচন্ডি মেলার দিনে একজন পুলিশকর্মীর সঙ্গে একজন পটকাবাজের বচসা হলে , মাতাল অবস্থায় পুলিশকর্মীটি দুই জন মুসলিমকে গুলি করে হত্যা করে। একই দিনে হাশিমপুরের ক্রসিং’এ স্থানীয় মুসলিমরা রমজানের শেষ শুক্রবার একটি ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করে। অন্য দিকে তারই নিকটবর্তী পূর্ব শাইখলালে হিন্দু পরিবার কর্তৃক মুন্ডন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মুন্ডন অনুষ্ঠানে লাউড স্পিকারে চলচ্চিত্রের গান চলছিল, যা মুসলিমদের মাহফিলে বিঘ্ন ঘটাচ্ছিল। কিছু মুসলিম যুবক লাউড স্পিকারে গান বাজানোর আপত্তি করলে শুরু হয় বচসা ।

জানা যায়, প্রথমে উগ্ৰ হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিমদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। প্রতিক্রিয়া হিসাবে কিছু মুসলিম যুবক হিন্দুদের কয়েকটি দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই দুই ঘটনায় মিরাটে শুরু হয় চরম সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা। এই অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে এক অজ্ঞাত মহলের উস্কানি ও ষড়যন্ত্রে মিরাটে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, যা ধীরে ধীরে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। প্রশাসন করফিউ জারি করে সাময়িক’ভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

অত:পর ধীরে ধীরে এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মিরাটের গ্ৰামে,শহরে, অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়ে। শরু হয় ভাংচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ,গুম, হত‍্যা প্রভৃতি ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ। পরিকল্পিত ভাবে চলতে থাকে ভয়ংকর হত্যালীলা । প্রায় তিন মাস ধরে চলে এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এই সময় উত্তর প্রদেশ ও কেন্দ্র উভয় জায়গাতেই কংগ্রেসের সরকার ছিল। প্রশাসনের ইচ্ছাকৃত অবহেলার কারণে তা ভয়ংকর, লোমহর্ষক, বেদনাদায়ক ও ধ্বংসাত্মক রূপ ধারন করে। হিংসা-প্রতিহিংসার বলি হয় অসংখ্য নিরীহ মানুষ। আর প্রতিটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ন‍্যায় এখানেও স্বাভাবিক ভাবেই দাঙ্গাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মূলত মুসলিমরাই।

দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে নিয়োগ করা হয় প্রায় ৬০ হাজার পুলিশ, ১১ টি কোম্পানি বাহিনী শহর জুড়ে মোতায়েন করা হয়। কিন্তু অভিযোগ ওঠে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী’র সামনেই চলতে থাকে ভাংচুর, লুটপাট, গুম, হত‍্যালীলা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনী উগ্ৰ হিন্দত্ববাদীদের ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে সাহায্য করে।

অভিযোগ, মিরাটে কারফিউ’তে নিয়োজিত পুলিশ ও সেনাবাহিনীর জোয়ানরা বেছে বেছে মুসলিমদের বাড়িতে তল্লাশি চালায়। তল্লাশির নামে তারা তাদের হয়রানি ও অত‍্যাচার করে। কোনো প্রমাণ ছাড়াই নিরপরাধ নিরীহ মুসলিমদের বন্দি করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় হাশিমপুরে শুরু হয় নিরাপত্তা বাহিনীর নারকীয় অত‍্যাচার।প্রত‍্যেক বাড়িতে গিয়ে তারা পুরুষদের মারতে মারতে জোর করে বের করে এনে রাস্তার উপরে দাঁড় করিয়ে রাখে। তারপর বাছাই করে প্রায় ৪৫ জন যুবককে নিয়ে তারা পিএসি এর ৪১ ব‍্যাটেলিয়নের একটি ট্রাকে তোলে। আর প্রায় ৩৫০ জনকে তারা গ্ৰেফতার করে জেলে নিয়ে যায়, সেখানেও তাদের উপরে চলে অত‍্যাচার।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় তিন মাস ব‍্যাপি চলা এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতে ১৭৪ জন ব‍্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল এবং ১৭১ জন মারাত্মক ভবে আহত হয়েছিল। কিন্তু বেসরকারী গবেষণা ও পরিসংখ‍্যান অনুজায়ী প্রায় ৩৫০ জনের মৃত্যু হয়েছিল এবং আহত হয়েছিল সহস্রাধিক। আর এর থেকেও বড় কথা, অসংখ্য মানুষ ভিটেবাড়ি, দোকানপাট, ব‍্যাবসায়ীক দ্রব্য হারিয়ে ছিল, উদ্বাস্তু হয় অগনিত মানুষ।

অত:পর, রাত নামলে প্রায় ৪৫ জনকে নিয়ে পিএসি এর ৪১ ব‍্যাটেলিয়নের একটি ট্রাক দিল্লি-গাজিয়াবাদ সীমান্তের মুরাদ নগরে গঙ্গা নহরের সামনে এসে থামে। সেখানে এক এক করে ঠান্ডা মাথায় তাদের গনহত্যা করতে শুরু করে পিএসি এর জওয়ানরা । এই লোমহর্ষক দৃশ‍্য দেখে ট্রাকের ভিতরে বাঁকিরা চিৎকার শুরু করলে ট্রাকের ভিতরেও গুলি চালানো হয়। মৃত ব‍্যক্তিদের লাশ সেখানে ফেলে দিয়ে বাকিদের নিয়ে যাওয়া হয় মকান্দপুরের হিন্দননালার কালভার্টের কাছে। সেখান অবশিষ্টদের উপর গনহত‍্যা চালিয়ে লাশ গুলো জলে ভাসিয়ে দেয়। এই ঘটনার তদন্তের পর ৪২ জনের হত‍্যার কথা নিশ্চিত করা হয়।

মকন্দপুরের ঘটনা স্থলের কাছেই লিংক রোড থানা। ২২ শে মে থানার দায়িত্বে ছিলেন এস.পি.বি.বি. সিংহ। গুলির আওয়াজ শুনে তিনি একজন পুলিশ কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে বাইকে করে যে দিক দিয়ে আওয়াজ এসেছিল সেই দিকে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে তিনি ৪১ ট্রাকটিকে দ্রুত গতিতে যেতে দেখেন। আধা সামরিক বাহিনীর পোশাক পরা কয়েক জনকে পিছনে দেখা যায়। তিনি দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে বাইকের আলোয় যা দেখেন তা বর্ণনাতীত। খালের কাছে ঝোঁপঝাড়ে চারিদিকে রক্ত, খালের জলে ভাসছে কয়েকটি মানুষের লাশ। পুলিশকর্মী হিসাবে এস পি বি বি সিংহের গুলির আওয়াজ, ৪১ ব‍্যাটেলিয়নের ট্রাক, খালের জলে রক্তাক্ত লাশ এগুলোর মধ‍্যে যে যোগ আছে তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি।

পুলিশ সুপার বিভূতীনারায়ন রাই ও জেলাশাসক নাসিম জাইদি প্রশাসনিক কাজে অন‍্যত্র ছিলেন। তাঁরা ফিরে এসে বি বি সিংহের কাছ থেকে জানতে পেরে ঘটনাস্থলে গিয়ে যা দেখেন তা ছিল অত‍্যন্ত হৃদয়বিদারক। তারা চারিদিকে খোঁজাখুঁজি করে একজনকে আহত অবস্থায় জীবিত পেলেন। কয়েকজন কে লাশগুলোর দায়িত্ব দিয়ে তাঁরা ফিরে এসে লিংক রোড থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। এরপর মামলা দায়ের করা হয় মুরাদনগর সেশন কোর্টে। এটি হল স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে পুলিশি হেফাজতে ঘটা সবচেয়ে বড়ো গনহত্যা।

মামলা দায়ের করা হলেও এই তদন্ত বন্ধ করার এবং বিচারে বাঁধা দানের ব‍্যাপক চেষ্টা করা হয় উত্তর প্রদেশের প্রভাবশালী একটি শ্রেণীর পক্ষ থেকে। প্রমাণ লোপাটের জন‍্য ট্রাকটিকে ভালো করে ধুয়ে মেরামত করা হয় যাতে রক্তের, গুলির দাগ ফরেনসিক পরীক্ষায় ধরা না পড়ে। প্রথমে তো দীর্ঘ দিন ট্রাকটিকে তদন্তকারীদের হাতে তুলে দিতে অস্বিকার করা হয়‌। অবশেষে তদন্তের শেষ লগ্নে এসে সেটি তদন্তকরীদের হাতে দেওয়া হয়।

উত্তর প্রদেশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের সেন্ট্রাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট প্রায় সাত বছর তদন্ত করে অবশেষে ১৯৯৪ সালে রিপোর্ট দেয়। কিন্তু রিপোর্টে উল্লিখিত প্রায় ৬৪ জন আধিকারিকের মধ্যে মাত্র ১৯ জনের নামে চার্জশিট দাখিল করা হয়। বিচার চলা কালেই এর মধ্যে আবার ৩ জন অভিযুক্তের মৃত্যু হয়।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে সেশন জর্জ ২৩ বার অভিযুক্তদের গ্ৰেফতারের ওয়ারেন্টি জারি করেন। কিন্তু বার বার তাঁকে জানানো হয় অভিযুক্তরা পলাতক। অথচ অভিযুক্তরা বহাল তবিয়তেই চাকরি করে যাচ্ছিল। এ যেন আদালতে সঙ্গে, গনতন্ত্রের সঙ্গে এবং সর্বোপরি মানবতার সঙ্গে প্রহসন চলছিল।

চার্জশিট দাখিলের পর অভিযুক্তদের নামে জামিন অযোগ্য ধারায় গ্ৰেফতারি পরওয়ানা জারি হলেও অজ্ঞাত মহলের অঙ্গুলি হেলনে ১৯৯৭-২০০০ সাল পর্যন্ত কাউকেই গ্ৰেফতার করা হয়নি। উল্টে বিচার প্রক্রিয়ায় প্রতি নিয়ত বাঁধা দান, স্বাক্ষীদের হুমকি দেওয়া হতে থাকে। ফলে প্রয়াত মানবাধিকার কর্মী ইকবাল আনসারী, মৃতদের পরিবার, স্বাক্ষীরা উত্তর প্রদেশ থেকে মামলা দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে আসার জন্য আবেদন করে। দিল্লির তিসহাজারি কোর্টে মামলা ট্রান্সফার হয়। তিসহাজারি কোর্ট ২০১৫ সালের ২১ মার্চ প্রমাণের অভাবে অভিযুক্তদের বেকসুর খালাস করে দেয়।

এই রায়ে স্বাভাবিক ভাবেই সকলেই হতবাক হয়ে যায়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, উত্তর প্রদেশ সরকার এবং এই ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া জুলফিক্বার নাসির নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে দিল্লি হাইকোর্টে আপিল করে। সুদীর্ঘ ৩১ বছর ধরে অদম‍্য সাহস, মনোবল আর লড়াকু মোনোভাব নিয়ে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পর অবশেষে ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর দিল্লি হাইকোর্ট ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে ১৬ জন পিএসি কর্মীকে দোষি সাব‍্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। রায় দিতে গিয়ে বিচারপতি মুরলীধর ও বিনোদ গোয়েল এর বেঞ্চ মন্তব্য করে , ” অসহায়, নিরস্ত্র মানুষদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছিল।”

Related Articles

Back to top button
error: