উপসম্পাদকীয়

টুরগা বিদ্যুৎ প্রকল্পে অযোধ্যা পাহাড়ে নিধন হবে ১২ লক্ষ গাছ

অভিমন্যু মাহাত: আজ, বিশ্ব পরিবেশ দিবসে ফেসবুক জুড়ে শুধুই পরিবেশ সংক্রান্ত নিউজ ফিড। অতিমারীর আবহে প্রায় সকলেই গাছ লাগানোর কথা বলেছেন। ‘একটি গাছ একটি প্রাণ’… নানান প্রবাদ বাক্য আওড়াচ্ছেন। এসব কী শুধুই ফেসবুকের জন্য ‘ফেসবুক পোস্ট?’ সংশয় জাগছে। কারণ এই বঙ্গেই ১২ লক্ষ গাছ কাটা হবে একটি তথাকথিত ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পের জন্য। কেউ তার বিরোধীতায় সোচ্চার হননি। তথাকথিত পরিবেশবিদদের কোনও আন্দোলন দেখা যায়নি বাংলায়। কবিরাও আজকাল বড্ড রাজনৈতিক বিশ্লেষক হয়ে উঠেছেন! প্রশ্ন জাগে!! কারও মেরুদণ্ড সোজা নয় নয় এই বঙ্গে! একমাত্র আদিবাসীরা রুখে দাঁড়িয়েছে।
কি সেই উন্নয়নমূলক প্রকল্প? আসুন জেনে নেওয়া যাক। বাম আমলে অযোধ্যা পাহাড়ের ১২০০ একর বনভূমি ধ্বংস করে গড়ে ওঠে পুরুলিয়া পাম্পড স্টোরেজ প্রকল্প (পিপিএসপি)। জাপান সরকারের আর্থিক সহায়তায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় এখানে। পাহাড়ের ১২০০ একর বনভূমি ধ্বংস হওয়ার কারণে লক্ষ লক্ষ গাছ কাটা পড়ে। সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হল, যেখানে পাহাড়ের বনভূমি ধ্বংস হয়েছে, সেখানে মেঘ এসে আছড়ে পড়ত। মেঘ ধাক্কা খাওয়ায় বৃষ্টিপাত ঘটত পাহাড়ের সন্নিহিত এলাকায়। পিপিএসপি গড়ে ওঠায়, এখন আর মেঘ ধাক্কা খায় না। বৃষ্টিপাতও হয় না। মেঘ উড়ে যায় অন্য প্রদেশে। পুরুল্যা মায়ের ‘লেলহা ছেল্যা হঁয়েই থাক্যে যায়’!
২০০৮ সালে উদ্বোধন হয়েছে পিপিএসপি। ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় এখানে। কিন্তু পুরুল্যার কতজন কাজ পেয়েছে? নাহ, পায়নি তোহ! কাজ পেয়েছে বাহারের লোক। পুরুলিয়ার বেকার ছেলেরা সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি পেয়েছেন। সেই চাকরি অবশ্য বেরসকারি সংস্থার। পাকা চাকরি কারও হয়নি। প্রকল্প গড়ে ওঠার পর স্বাস্থ্য বা শিক্ষার উন্নতি? নাহ, তাও হয়নি। পাথরডি ব্লক প্রাথমিক স্থাস্থ্যকেন্দ্র এখনও রেফার কেন্দ্র হিসেবেই পরিচিত। আযোধ্যা পাহাড়ের প্রাথমিক স্কুলগুলিতে আজও শিক্ষকের অভাব। একটি মাত্র উচ্চ বিদ্যালয়! চার বছর আগেও মেয়েদের জন্য পৃথক স্কুল ছিল না। এখন অবশ্য একটি হয়েছে। পাহাড়ের উপরে কোনও কলেজ নেই।
এরই মাঝে আবার একটি প্রকল্প। টুরগা ঝর্নাকে বাঁধ দিয়ে পাম্পড স্টোরেজ প্রকল্প তৈরি করার কাজ চলছে। যার অনুমতি দিয়েছে বর্তমান রাজ্য সরকার। ৩৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প গড়ে উঠছে। ধ্বংস হবে ৫০০ একর বনভূমি। প্রায় ১২ লক্ষ গাছ কাটা পড়বে। সম পরিমাণ বনভূমি তৈরি করা হবে বীরভূম, বর্ধমান জেলায়। তাতে পুরুলিয়ার কি লাভ হবে? এই প্রকল্পেও বনভূমি ধ্বংসের কারণে মেঘ আছড়ে পড়বে না অযোধ্যা পাহাড়ে। বর্ষায় যেটুকু মেঘ পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে বৃষ্টিপাত হত, তাও আর হবে না। ‘পুরুল্যা খরার দেশ, আরও রুক্ষ থেকে রুক্ষতর বৈনব্যেক।’ বিদ্যুৎ প্রকল্প তো অন্যত্রও করা যেত, কেন বমভূমি ধ্বংস?
৫০০ একর বনভূমি ধ্বংস হলে বনে থাকা বন্যপশুরা কোথায় যাবে? ময়ূর, হরিণ, বন বিড়াল, শূকর, হুড়াল, খরগোশ, সাপ, অন্যান্য পশুপাখি এরা কোথায় যাবে? জীব বৈচিত্রের ভারসাম্য নিয়ে তো ভাবার কেউ নেই। ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাই। তাতে পাহাড় বা যতই বনভূমি ধ্বংস হোক। উন্নয়ন চাই। আর এই উন্নয়নই ‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে’। প্রকল্প স্থগিতাদেশের দাবিতে একমাত্র আন্দোলনে নেমেছেন আদিবাসীরা। কিন্তু রাজ্য সরকার একরোখা। জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তাদের গড়তেই হবে। তাই আন্দোলন দুরমুশ করতে পুলিশকে নামিয়েছে। নেমেছেন শাসক দলের নেতারা।
একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে এক লক্ষ ৩৮ হাজার একর বনভূমি ধ্বংসের সিলমোহর পড়েছে। প্রায় ২৮০০টি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য এই বনভূমি ধ্বংসের আয়োজন। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৮০ হাজার আদিবাসী উচ্ছেদ হতে চলেছেন। জঙ্গল থেকে আদিবাসীরা উচ্ছেদ হলে জমি যাবে কর্পোরেট সংস্থার হাতে। অযোধ্যা পাহাড়ের খয়রাবেড়া ড্যামের পাড়ে রিসর্ট বানানো তার অন্যতম উদাহরণ। কলকাতার সিনেমা জগতের এক ব্যবসায়ী রিসর্ট বানিয়েছেন পাঁচ হাজারের বেশি গাছ কেটে বলে অভিযোগ। ড্যামের পাড়ে রিসর্ট বানানো পুরোটাই বেআইনি। অথচ জেলা প্রশাসনের কর্তাদের ডেকে এনে মোচ্ছব করিয়ে ওই বনভূমির লিজ নিয়েছেন সেই ব্যবসায়ী বলেও অভিযোগ। শুধু খয়রাবেড়া ড্যাম নয়, গোটা পাহাড় জুড়েই এখন কর্পোরেট সংস্থার থাবা। পর্যটনের নামে যেটুকু ব্যবসা হচ্ছে, তার গুড় খাচ্ছে কর্পোরেট সংস্থার মালিকরা।
তবে আর ‘মানব্যেক নাই’ আদিবাসীরা। বনভূমি ধ্বংস করে রা‌জ্য সরকারের বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধিতায় নেমেছে তারা। ‘ঢেঁড়া পিটা চৈলছ্যে। বৈলছ্যে, হামদের পাহাড়, হামদের জঙ্গল ফিরাই দাও। নাইলে হবেক আরেক উলগুলান।’
(অভিমন্যু মাহাত ফেসবুক থেকে নেওয়া)

https://www.facebook.com/100000746360165/posts/4250097721691731/

Related Articles

Back to top button
error: