সাহিত্য ও সংস্কৃতি

গল্পের নাম:- “রিজু বাঁচতে চেয়েছিলো” গল্পকার:- মোস্তফা কামাল (পর্ব ৩১)

(পর্ব ৩১)

ক’দিন থেকে মিতা রিজুকে এড়িয়ে চলে। ঠিক মতো কথা বলতে চায়না। মিতার রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করে রিজু। হাত ধরে পাশে বসাতে চায়। ছাড়ো আমাকে, বলে মিতা সরে বসে। বিড়বিড় করে কি সব বলে। রিজু সরতে চায়না। আরও ওর গা ঘেঁষে বসার চেষ্টা করে। এবার মিতা ঝাঁঝিয়ে ওঠে। বলে, যাওনা শালিনীর কাছে। আমি তোমার কে? আমাকে তো তুমি ভালোবাসোনা। তবে কেন এমনটি করছো?

……. কে বললো তোমাকে ভালোবাসি না? ভালোবাসিনা তো এমনি এমনি তোমার সঙ্গে এতোগুলো বছর ধরে ঘর করছি? এই মিতা, কাছে এসো। একটু পাশে বসো।

…… না, বসবো না। আমাকে আর সোহাগ দেখাতে এসো না। আমি সব বুঝি! বাড়িতে একটা কুকুর দীর্ঘদিন থাকলে তারও প্রতি মায়া পড়ে যায়। তাকে তাড়ানো যায়না। আমি কুকুরের মতো তোমার সঙ্গে ঘর করি। তুমি আমাকে তাড়াওনি এটাই আমার ভাগ্য। আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আমার বাপও হয়েছে তাই! মেয়ের প্রতি তার বৈমাত্রিক সুলভ আচরণে বাপের বাড়িও যাওয়া বন্ধ হয়েছে আমার। আমি এক অসহায় নারী। আমার আর কিছুই ভালো লাগছেনা। তুমি আমাকে একটু একা থাকতে দাও প্লিজ!

মিতার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। রিজু ডান হাত দিয়ে মিতার চোখ দুটো মুছে দেয়। সান্ত্বনা দেয়। তুমি কেঁদোনা মিতা, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার চলার পথকে তোমার কান্নার জল দিয়ে পিচ্ছিল করে দিওনা। আমাকে বোঝার চেষ্টা করো। তুমি আমার স্ত্রী! সুখ দুঃখের সাথী। তুমি না বুঝলে আর কে বুঝবে? প্লিজ তুমি কেঁদোনা।

স্বামীর সোহাগে মিতা এবার নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা। রিজুর কোলে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে ওঠে। বলে, তুমি আমাকে কষ্ট দিওনা রিজু! আমি তোমাকে খুউব, খুব ভালোবাসি গো! তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। আমাকে পর করে দিওনা তুমি।

কোল থেকে মিতার মাথাটা তুলে নিয়ে রিজু বুকের মধ্যে টেনে নেয়। পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে। বলে, ভালোবাসতে শেখো, ভালোবাসা দিতে শেখো, তাহলে দেখবে তোমার জীবনে ভালোবাসার অভাব হবে না। আমাকে তোমার খুব আপন মনে হবে। আমার দুঃখ কষ্টটা তোমার নিজের মনে হবে।

…… তোমার দুঃখ কষ্ট দেখতে গেলে তো আমাকে শালিনীকে মেনে নিতে হবে! আমি ওটা পারবোনা রিজু। তুমি শালিনীকে ভুলে যাও। আমাকে শালিনীর কাছে পরাজিত করোনা। আমি তোমার পায়ে ধরি, প্লিজ তুমি শালিনীকে ভুলে যাও। ও যদি আমার স্বামীর ভাগ বসাতে আসে আমি বাঁচবো না গো! আমি মরে যাব। তোমার ভালোবাসার ভাগ আমি পৃথিবীর কাউকে দেবো না। তোমার হৃদয়ে আরেক জনের নাম লেখা থাকবে কী করে আমি তা সহ্য করবো! ওখানে আমিই একমাত্র ভালোবাসার রাণী হয়ে থাকতে চাই। এখানে কারোর জায়গা আমি দেবোনা।

…… মিতা! মুখ তোলো ! প্লিজ আমাকে বোঝার চেষ্টা করো! আমি তো তোমারই।

রিজু বুঝতে পারে না ও এখন কী করবে। ওদিকে শালিনী পথ চেয়ে বসে আছে । রিজু কথা দিয়ে এসেছে। এবার তাকে কথা রাখতেই হবে। শালিনীর ভাঙ্গা হৃদয়টাকে আর নতুন করে ভাঙ্গতে চায়না রিজু। যে করেই হোক মিতাকে বোঝাতেই হবে। কিন্তু মিতা তো অবুঝ। রিজু চারদিকে অন্ধকার দেখে।

……. কেন জানি না আমার কেমন ভয় করছে। মনে হচ্ছে তুমি আমার পর হয়ে যাবে। তুমি আমার কাছ থেকে হয়তো অনেক দূরে চলে যাবে। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি গো! প্রাণের চেয়েও ভালোবাসি! হৃদয় দিয়ে তোমায় ভালোবাসি!

…… আমি জানি মিতা। তোমার ভালোবাসার জন্যই এতোদিন এইভাবে বেঁচে আছি। নইলে………!

……. নইলে কি? এই কথা বলো! নইলে কি? কী করতে তুমি? তুমি শালিনীকে বিয়ে করতে?

…….. দ্যাখো মিতা, কথায় কথায় তুমি শালিনীর কথা বলো না।

……. কেন বলবোনা? বলবো! একশোবার বলবো। তুমি আমাকে নয়,শালিনীকেই বেশি ভালোবাসো।

……. হ্যাঁ, বাসিই তো! তাতে কী হয়েছে?

…… একথা তুমি বলতে পারলে? আমার দুঃখ যন্ত্রণা তোমার হৃদয়ে এতটুকু রেখাপাত করে না রিজু? সারাজীবন নিঃস্বার্থ ভালোবেসেও তোমার মনে এতোটুকু জায়গা নেই আমার? আমি বুঝতে পারি না, আমার দ্বারা আর কী করলে তোমাকে ভালোবাসা যাবে! কী করলে তোমার মন পাবো! আসলে তোমার হৃদয়ে তো আমার কোনো স্থান নেই, ছিলোও না। তুমি তো বাধ্য হয়ে তোমার অপছন্দের মেয়েকে বিয়ে করেছো। জোর করে ভালোবাসা হয় না। ভালোবাসা যায় না রিজু। লোক লজ্জায় তুমি আমার সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করে চলো আমি বুঝি রিজু।

….. রিজু চুপ থাকে। মিতা বলেই চলে। এই পরিস্থিতির জন্য তোমার বাবাকে দায়ী করতে খুব ইচ্ছে করে আমার। একজন দায়িত্ববান বাবা ছেলের জোর করে বিয়ে দিয়ে দুটো জীবনকেই সমস্যার বেড়াজালে ফেলে দিয়েছেন। আমাকে ঠকানো হয়েছে। হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠকানো হয়েছে। তুমি অন্য মেয়েকে ভালোবাসো জেনেও তোমার বাবা আমার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন। তিনি আমাকে ঠকিয়েছেন। আমার বাবারও উচিত ছিল আমি যেমন, তেমন ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া। আমি তো এমনটি চাইনি। আমি চেয়েছিলাম এমন একজন জীবনসঙ্গী , যে সারাজীবন আমাকেই ভালোবাসবে। কিন্তু এমনটা হলো কেন? এসব আমার বাবার লোভের ফল। বাবা তোমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে আমাকে তোমার হাতে তুলে দিয়েছেন। অপরাধ করেছেন বাবা। তার প্রায়শ্চিত্য তো আমাকে করতেই হবে। কিন্তু আর কতোদিন করবো? আর কতোদিন? আমি যে আর পারছিনা রিজু! এর থেকে মরে যাওয়া অনেক ভালো ছিলো!

….. অমন কথা বলোনা প্লিজ! তুমি আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করো মিতা! আমার পরিস্থিতি তোমার বোঝা উচিত। আমার স্ত্রী হিসেবে আমার সম্মান রক্ষা করার দায়িত্ব তোমারও।

…… কী করতে হবে বলো আমাকে!

……. শালিনীকে মেনে নিতে হবে তোমায়!

…….. এ আমি পারবোনা! তুমি শালিনীকে বিয়ে করলে আমি বাঁচবো না! আমার চোখের সামনে তুমি তাকে নিয়ে ফূর্তি করবে তা দেখে আমি কখনোই সহ্য করতে পারবোনা!

……মিতা! তুমি এসব কী বলছো? তুমি বলতে পারলে এসব কথা? এখন কি আমার ফূর্তি করার বয়স? তুমি ভুল বুঝোনা প্লিজ! হতভাগী শালিনী যে আমার পথ চেয়ে বসে আছে। ওকে আমি যে কথা দিয়ে এসেছি মিতা! মরিচা ধরা ছিন্ন তারে নতুন করে বাঁধন দেওয়ার স্বপ্ন আমি তাকে দেখিয়ে এসেছি! একটু বোঝার চেষ্টা করো মিতা! তোমায় কোনো কষ্ট আমি দেবোনা। সারাজীবন তোমার গোলাম হয়ে থাকবো। শুধু এইটুকু তুমি মেনে নাও! নিশ্চয়ই তুমি চাওনা তোমার রিজু আবার তার বিবেকের কাছে পরাজিত হোক?

…….. আমি বুঝতে পারছি তুমি তোমার সিদ্ধান্তে অনড় থাকবে। আমার কথা তুমি শুনবে না! তাহলে আমার আর কীইবা বলার আছে! আমি তো তোমাকে সুখ দিতে পারিনি। শালিনী তোমাকে সুখী করাবে। ঠিক আছে! তুমি শালিনীকে বিয়ে করো, তাকে নিয়ে সংসার পাতো! তুমি সুখী হও! আমার কথা ভেবোনা। তুমি যেদিন বিয়ে করে শালিনীকে নিয়ে আমার এই ঘরে আসবে সেদিন দেখবে এই ঘরের দরজায় আমার লাশ পড়ে আছে! আমি তোমার রাস্তা পরিষ্কার করে দিয়ে চলে যাবো! বাধা দিতে তোমার মিতা আর আসবে না! তুমি আমাকে ক্ষমা করো!

…… না মিতা, তুমি এটা করতে পারোনা! তুমি আমার শীর্ষ আসনেই থাকবে। আমাদের সাজানো সংসারে শালিনী তোমার ছোট বোন হয়ে থাকবে। দেখবে ও খুব ভালো মেয়ে! তুমি তো দেখেছো, আমাদের সংসারে অশান্তি হবে বলে ও এতোগুলো বছর কত কষ্ট করে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলো! আমি ওর প্রতি বড়ো অবিচার করেছি মিতা! আমাকে সংশোধনের একটু সুযোগ দাও! না হলে শালিনীর এই পরিণতির জন্য আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন না! আমি নিজেও যে শান্তি পাচ্ছিনা মিতা!

…… এটা কখনোই হয়না। আমি বেঁচে থাকতে পারবোনা!

….. একজন মেয়ে হয়ে মেয়ের দুঃখ কষ্ট তোমার বোঝা উচিত মিতা? শালিনীর জায়গায় নিজেকে একটু বসিয়ে দেখো তুমি ঠিক করছো না ভুল করছো!

…… না রিজু আমাকে আর তুমি বোঝাতে এসোনা। আমি যা বলার বলে দিয়েছি। এখন সিদ্ধান্ত তোমার, আমার নয়!

…… সেই পঁচিশ বছর আগে বাসর রাতে আমায় তুমি কথা দিয়েছিলে, আমার সুখ তোমার সুখ! আমার দুঃখ, তোমার দুঃখ! আমরা একসাথে সুখ দুঃখের সাথী হয়ে বাঁচবো! তোমার সেই প্রতিশ্রুতির কথা মনে পড়ে মিতা? আমার দুঃখের ভাগ তুমি একটু নাও মিতা! আমি যে একা বহন করতে পারছিনা!

…….. আমি সব দুঃখের সাথী হতে রাজি কিন্তু আমার সুখের ভাগ কাউকে দিতে রাজি নই। সুখের ভাগ দিলে যে আমি দুঃখের সাগরে ভেসে যাবো রিজু! তখন তুমি কী করবে?

…… আমরা কি একসাথে সুখের ভাগিদার হতে পারিনা? তুমি মেনে নিলে আমিও যে দুঃখ সাগর থেকে একটু মুক্তি পাই!

…… আচ্ছা রিজু, তুমি একই কথা কেন বারবার বলছো? আমি মেনে নিলেও সমাজের চোখে তুমি কতটা ছোট হয়ে যাবে ভেবে দেখেছো? তুমি একজন ভালো শিক্ষক, তোমাকে সবাই কতো সম্মান করে। আজ যখন জানবে এই বুড়ো বয়সে তুমি তোমার প্রাক্তন প্রেমিকাকে দ্বিতীয় বিয়ে করছো তাহলে তোমার সম্মান কোথায় থাকবে ভেবে দেখেছো?

……. তুমি ঠিকই বলেছ মিতা। লোকে আমাকে খারাপ বলবে, আমার সম্মান নষ্ট হবে এটাও ঠিক। তাই বলে লোকের ভয়ে, সম্মানের ভয়ে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারবোনা?

…… তুমি কোনো পাপ করোনি রিজু। পাপ করেছে শালিনী, পাপ করেছে তোমার পিসিমা।

…… মিতা! তুমি এতবড়ো কথা বলতে পারলে? তোমার স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হচ্ছি! খবরদার পিসিমার নামে আর একটা কথাও বলবেনা! ঐ পিসিমার জন্যই তুমি এখনও আমার স্ত্রী হয়ে এই বাড়িতে আছো! একটু ভাবনা চিন্তা করে কথা বলবে!

……. রিজু! একটা পরের মেয়ের জন্য আমাকে এভাবে কথা বলতে পারলে?

…… পর? কিসের পর? তুমিও তো পর ছিলে!

…… কার সঙ্গে কার তুলনা করছো তুমি?

…… তুলনা নয়, তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি।

…… আমাকে মনে করিয়ে দিতে হবেনা। তুমি কোথায় ছিলে আর কোথায় এসেছো এটাও তোমার মনে রাখা দরকার। তোমার এখন টাকা হয়েছে বলে যা খুশি তাই করবে?

……. কী বলতে চাইছো তুমি?

……..ছিলে তো একটা গরীবের ছেলে! আমার বাবা দয়া না দেখালে তোমার এতো অহংকার কোথায় থাকতো?

মিতার কথাগুলো রিজু আর সহ্য করতে পারেনা। তুলতুলে গালে সপাটে একটা চড় মারে। মিতা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। পাশের ঘর থেকে খুশি আর তানু ছুটে আসে। মাকে কাঁদতে দেখে তানু মিতাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদে। খুশি বাবাকে দোষারোপ করে। বলে, “পাপা আপনি মায়ের গায়ে হাত তুলতে পারেন না। আইনের চোখে এটা অপরাধ। মনে রাখবেন আপনার মেয়ে এখন আইনের ছাত্রী। মায়ের উপর এই অবিচার আমি মেনে নেবো না।”

রিজু লজ্জিত হয়। মেয়ের সামনে কথা বলতে পারে না। শালিনীর মায়াভরা মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। চারদিকে অন্ধকার দেখে। বের হওয়ার পথ খুঁজে পায়না। একপ্রকার পাগলের মতো সারা ঘরময় ছুটে বেড়ায়। তারপর একবুক হতাশা নিয়ে ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে যায়।

Related Articles

Back to top button
error: