সাহিত্য ও সংস্কৃতি

গল্পের নাম:- “রিজু বাঁচতে চেয়েছিলো” গল্পকার:- মোস্তফা কামাল (পর্ব ৩২) শেষ পর্ব

*শেষ পর্ব*(পর্ব ৩২)

মিতা সারারাত ঘুমায়নি। বালিশে মুখ গুঁজে শুধু কেঁদেছে। রিজুকে হারানোর ভয় তাকে গ্রাস করেছে। রিজুও ঘুমাতে পারেনি। শালিনীর অসহায়ত্ব আর মিতার জেদ যেন ভূমধ্যসাগরে ভাবনার জলে তাকে নিক্ষেপ করেছে। উঠে আসার কোনো পথ নেই।

শালিনীর স্বপ্ন পূরণ হওয়ার দিন আজ। সে হয়তো খুব আনন্দে আছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর তার দুঃখের অবসান ঘটবে। আজ হয়তো ও খুব সকাল সকালে বিছানা থেকে উঠেছে। রিজুর ভাবনায় এখন মশগুল আছে। আর রিজু? সে ডুবন্ত সংসারটাকে বাঁচাতে অন্ধকারে হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এক্ষেত্রে মিতা তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী!

আসলে সেই জন্মলগ্ন থেকেই যেন সবাই রিজুর প্রতিদ্বন্দ্বী। তার জীবন ঘাত প্রতিঘাতের ঘূর্ণাবর্তে আবদ্ধ। কোনো অদৃশ্য পরাশক্তি তার সব হিসাব নিকাশ ওলোট পালোট করে দেয়। স্বপ্ন ভাঙ্গার ঢেউ এসে তাকে বিদ্ধস্ত করে বারবার। প্রতিনিয়ত ছন্দপতনের শব্দে রিজুর ঘুম ভাঙ্গে। সকাল হয় তমসাচ্ছন্ন অমানিশায়।

কোনদিনও রিজুকে কেউ বুঝতে চায়নি। মিতাই বা বুঝবে কেন? তাকে বুঝবার দায় কারোর নয়। কিন্তু সবাইকে বোঝার সব দায় যেন রিজুর। তাই দায় বহনের ভারে রিজু আজ নূব্জ্য। আর কিচ্ছুটি ভালো লাগেনা তার। সুখ স্বপ্নের অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে সে আজ বড্ডো ক্লান্ত।

বাল্যাবস্থা থেকে বাবা মায়ের দুই বেলা প্রহার আর অবজ্ঞার মধ্যে দিয়ে তাকে বড়ো হতে হয়েছে। এতোগুলো বছর পার হলেও সে কাউকে সুখী করতে পারেনি। সবাই রিজুর প্রতি অসন্তুষ্ট। তার বাবা-মা,ভাই-বোন স্ত্রী কন্যা সবাই তাকে ভুল বোঝে। কর্মক্ষেত্রেও তার সমস্যার শেষ নেই। সালাম মাস্টার তার ক্ষতি করার জন্য সবসময়ই ওৎ পেতে বসে থাকে। রাজনীতিতেও সে অচ্ছুত। কিন্তু কেন ? তার সততার জন্য নাকি তার ভুলের জন্য? রিজুর কাছে এর কোনো উত্তর নেই।

রিজু শুধু ভালোবাসার কাঙাল। কিন্তু সেই ভালোবাসা-ই রিজুর জীবনে অত্যাচার হয়ে বারবার নেমে আসে! কেন এমনটি হয়? তার মনে হয় পৃথিবীতে ভালোবাসার অত্যাচার হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ানক অত্যাচার। এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে কখনো কিছু বলা যায় না, শুধু নীরবে সহ্য করে নিতে হয়। রিজুর অপরাধ, সবসময় সব কিছু সহ্য করে সে অন্যের জন্য একটু ভালভাবে বাঁচতে চেয়েছে। যা কিছু করেছে সবার ভালোর জন্য করেছে। নিজের জন্য কখনোই ভাবেনি। রিজু আর এই অপরাধ করবেনা। আজ সে নিজের জন্য ভাববে। শুধুমাত্র নিজের জন্য সম্পর্ক তৈরি করবে।

রিজুর ফোন বেজে ওঠে। স্ক্রিনে শালিনীর নাম ভাসে। ফোন রিসিভ করতে হাত কাঁপে। কী বলবে শালিনীকে? কী করবে এখন? ভগ্ন হৃদয় নিয়ে কাঁপা হাতে রিসিভ করে কানে ধরে। ওপার থেকে বলে,

…….. হ্যালো! রিজু?

…… হ্যাঁ, শালিনী। রিজু বলছি।

……. কেমন আছো? তোমাকে দেখার জন্য মনটা খুব ছটফট করছে। দেরি আর সইছে না যে।

……. আমি ভালো আছি শালিনী। আমি তোমার অপেক্ষায় আছি। খুব শীঘ্রই তোমার আমার দেখা হবে।

…. .. এই শোনো! আমি আজ সারা রাত আনন্দে ঘুমোতে পারিনি। খুব সকাল থেকেই সাজতে শুরু করেছি। একদম তোমার মনের মতো করে। তুমি লাল শাড়িতে আমাকে খুব পছন্দ করতে। আজ টুকটুকে লাল শাড়ি পরেছি। মা নিজের হাতে সাজিয়েছেন। হাতে দিয়েছি লাল মেহেন্দি । তুমি দেখে চোখ ফেরাতে পারবেনা। পৃথিবীকে আজ আমার খুব সুন্দর লাগছে! তুমি আমায় নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছো। তোমার কোলে মাথা রেখে আমি এই পৃথিবীতে অনেকদিন বাচঁতে চাই রিজু! অনেকদিন…….!

……. নিশ্চয়ই বাঁচবে। আমি বেঁচে থাকলে তুমিও বাঁচবে শালিনী।

……. তুমি কখন আসছো?

…….. আমি ঠিক চলে যাবো। তুমি হয়তো আমাকে দেখে চমকে উঠবে!

….. অমন করে বলোনা গো! আমি তোমাকে দুচোখ ভরে দেখতে চাই। মরুভূমির বুকে তুমি বৃষ্টি হয়ে এসো। আমি সেই বৃষ্টিতে প্রাণভরে ভিজতে চাই রিজু!

ফোন রেখে দেয় রিজু। কিছুক্ষণ পর খুশি চা দিয়ে যায়। তাকে জিজ্ঞেস করে, তোমার মা কোথায় বেটা?

….. মা শুয়ে আছেন। মায়ের মন ভালো নেই। আমি ডেকে দেবো?

….. না, থাক।

রিজু বুঝতে পারে মিতা খুব কষ্ট পেয়েছে। কষ্ট পাবেই তো! এই পরিস্থিতিতে সব মেয়েই কষ্ট পাবে। এতে মিতার কোনো দোষ নেই। চা পান করে ধীরে ধীরে রিজু মিতার কাছে যায়। পাশে বসে। ওর চোখের কোণ সিক্ত হয়ে আছে। তার মানে ও আজ সারারাত ঘুমায়নি। কেঁদেছে। মিতা মুখ তুলে করুণ চোখে রিজুর দিকে চায়। ওর নরম বুকে মাথা রাখে রিজু। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। আজ মনে হয় মিতাকে সে প্রাণাধিক ভালোবাসে। তাকে কোনো মূল্যে হারাতে চায়না। তাহলে এই মুহূর্তে কী করবে রিজু! মিতা শালিনীকে ছাড়তে বলেছে। না হলে ও সারাজীবনের জন্য রিজুকে ছেড়ে যাবে। ওদিকে শালিনী বিয়ের সাজে অপেক্ষায় আছে। রিজু না গেলে শালিনী বাঁচবে না। শালিনীকে বাঁচালে মিতা বাঁচবে না। মিতা কিছু বলেনা। শুধু ফ্যালফ্যাল করে রিজুর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। মিতার কেন যেন মনে হয়, রিজুর সঙ্গে এটাই হয়তো তার শেষ দেখা।

তানু এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। ও একটু দেরিতেই ওঠে। রিজু পাশের ঘরে গিয়ে ঘুমন্ত তানুর কপালে চুম্বন করে। রিজুর বুকটা আজ হাহাকার করছে কেন সে বুঝতে পারে না।সবার জন্য তার প্রাণ আজ মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছে। খুশিকে আদর করে। রিজুর চোখ দিয়ে আপনা আপনি জল গড়িয়ে পড়ে। খুশি বাবার এই অবস্থা দেখে কেঁদে ফেলে। খুশিকে আদর করে বলে, ভালো থেকো মা আমার! আমার তানুকে দেখো!

…… পাপা আপনি এসব কী বলছেন?

….. কী জানি রে মা! আমার হৃদয় ছিড়ে আপনা আপনিই কথাগুলো বেরিয়ে আসছে! আমি এসব বলতে চাইছি না! তবুও কেন বলছি আমি নিজেই জানিনা বেটা!

…….. মিতা পাশের ঘর থেকে এসে রিজুর পায়ে পড়ে যায়। দুহাত দিয়ে পা দুটো জড়িয়ে ধরে কান্নায় ফেটে পড়ে। রিজু! তুমি আমাকে পর করে দিওনা গো! তুমি ছাড়া আমি বাঁচবো কী করে!

…… পা ছাড়ো। আমিও বাঁচতে চাই মিতা! তুমি আমাকে বাঁচার পথ বলে দাও!

…… আমি জানি না! তুমি আমার কথা না হয় ছেড়ে দাও! হাসি খুশি আর তানুর কী হবে তুমি ভেবে দেখো! ওরা কি ভালো থাকবে ভেবেছো? অন্তত ওদের কথা ভেবে তুমি শালিনীকে ভুলে যাও!

…… ওটা আমি পারবোনা মিতা। ওকে আমি কথা দিয়েছি। আমাকে প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দাও তুমি! দীর্ঘ পঁচিশটি বছর পর ও আজ বধূ সাজে অপেক্ষা করছে। আজ আমি আর তার সঙ্গে প্রতারণা করতে পারবো না মিতা! তুমি আমায় শালিনীকে ভুলতে বলো না। আমি তাকে ভুলতে পারবো না!

…… ওহ্! আমার আর কিছু বলার নেই! তাহলে তুমি আমাদের কাউকে ভালোবাসো না! খুশি , তোরাও আজ থেকে জেনে রাখ, তোদের পাপা আর তোদের থাকলো না! তোদের করে রাখতে পারলাম না রে! কান্নায় ফেটে পড়ে মিতা।

রিজু কথা বলতে পারে না। মনটাকে শক্ত করে। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে শালিনীর পছন্দের সাদা রঙের জামাটা পরে নেয়। শালিনী বলতো, “আমার সাদা রঙ ভীষণ পছন্দের। রিজু, তোমাকে সাদা রঙের জামা পরলে খুব সুন্দর দেখায়।” রিজু আর দেরি করে না। মোটর সাইকেলে স্টার্ট দেয়। ছাদের উপর দাঁড়িয়ে মিতা আর খুশি চোখ মুছতে থাকে। রিজু আড়াল হয়।

দ্রুত গতিতে গাড়ি ছোটে। গাড়িরও যেন আজ খুব তাড়া। আপনা আপনিই পিক আপে চলে যাচ্ছে। রিজুর মাথাটা ঠিক মতো কাজ করছেনা। মিতার করুণ মুখ ভেসে উঠছে বারবার। হাসি খুশি তানুর কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে রিজুর বাবা মা ভাই বোনদের কথা। স্কুলের সহকর্মী ও ছাত্র-ছাত্রীদের কথা, পাড়া-পড়শির কথা। সব মুখগুলো একসাথে ভেসে উঠছে। তারা যেন রিজুর এই অসহায় পরিস্থিতির জন্য রিজুকেই দায়ী করছে। তাদের চোখে রিজুই অপরাধী। না হলে পঁচিশটি বছর পর কেন শালিনীর জন্য রিজু আজ নিজের পরিবারকে জলাঞ্জলি দিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে? কারা যেন বলছে ফিরে চল রিজু, ফিরে চল! নিজের সাজানো গোছানো পরিবারটাকে এভাবে নষ্ট করিস না। তোর মান সম্মান নষ্ট করিস না।

দ্রুত গতিতে গাড়ি ছুটে চলেছে। বিড়বিড় করে রিজু বলে চলেছে, না,না! আমার ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। ফেরার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। আমার বাবা মা ভাই বোন কেউ নেই। কতো ভালবেসেছি তাদের, কিন্তু কোনদিনই আমি কোনদিন ওদের নিজের করে পাইনি। ওরা আমাকে কেউ ভালোবাসে না! ওরা শুধু ওদের কথাই ভাবে। এই পৃথিবীতে আমার যন্ত্রণা বোঝার কেউ নেই! মিতাও আমাকে বুঝতে চাই না। আমাকে মানসিক প্রশান্তি দেওয়ার কেউ নেই! আমি আজ বড়োই একা! বড়ো অসহায়!

আর একটু গেলেই শালিনীদের বাড়ি। ঘনঘন শালিনীর ফোন বেজে উঠছে। চলন্ত গাড়িতে রিজু ফোন ধরতে পারে না। গাড়ি থামিয়ে ফোন ধরতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। না, দেরি করা যাবেনা। একেবারেই শালিনীর সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। শালিনী চমকে উঠবে। ও দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়াবে। অথবা বধূ সাজে সজ্জিত হয়ে লজ্জায় মুখ লুকাবে। রিজুর শরীর পুলকিত হয়। ঠোঁটের কোণে হাসির ঝলক খেলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই শালিনীর পছন্দের পোশাক পরে রিজু তার সামনে দাঁড়াবে। এই তো আর একটু হলেই পৌঁছে যাবে শালিনীদের বাড়ি।এসব ভাবতে ভাবতে রিজু প্রায় পৌঁছে গেছে শালিনীদের বাড়ির কাছাকাছি। এমন সময়ে ওর গা ঘেঁষে একটা মাল বোঝাই ট্রাক হুঁস করে বেরিয়ে যায়। রিজু সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সামলে ওঠার আগেই আর একটা পাথর বোঝাই ট্রাক সামনে চলে আসে। রিজু সামলাতে পারেনা। গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। একটা বিকট শব্দে মোটরসাইকেলটা দুমড়ে মুচড়ে দূরে ছিটকে পড়ে। সাদা রঙের জামাটা শতছিন্ন হয়ে লাল রক্তে রাঙা হয়ে ওঠে।

……….…সমাপ্ত………..

Related Articles

Back to top button
error: