সাহিত্য ও সংস্কৃতি

গল্পের নাম:- “রিজু বাঁচতে চেয়েছিলো” গল্পকার:-মোস্তফা কামাল (পর্ব ২৪)

(পর্ব ২৪)

আজ রবিবার। ছুটির দিন। রিজু মাস্টার বাড়িতেই আছেন। মিতা চা দিয়ে গেল। কাপে চুমুক দিতেই কলিং বেলটা বেজে উঠল।

………কে?

………আমরা স্যার। আকাশ আর সুমন। আপনার প্রাক্তন ছাত্র।

দরজা খুলে দেন রিজু মাস্টার। আকাশ সুমন স্যারের পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে যায়। তিনি বাধা দেন। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন। মিতাকে চা করে আনতে বলে ওদের সঙ্গে গল্পে মেতে ওঠেন।

আকাশ এখন একটা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সুমন আর্মি অফিসার। রিজুর খুব গর্ব হয় ওদের জন্য। অনেক ক’টা বছর পর তার প্রিয় ছাত্রদের সাথে দেখা। রিজু স্যারের বন্ধুত্ব সুলভ আচরণে ওরাও ভীষণ খুশি। ওরা জানতে চায় তাদের প্রিয় স্যারের কাছে, স্যার নাকি আবার স্বপ্নের ভেড়ামারা হাই স্কুলে ফিরতে চান। ওদের চোখে মুখে একটা আনন্দের ছাপ। সুমন বলে, আপনি চলে আসার পর থেকে আমরাও আর ঐ স্কুলে যাইনা স্যার। আপনি এলে স্কুলটা প্রাণ ফিরে পাবে। আমাদের এলাকায় সব জায়গায় আলোচনা হচ্ছে। আপনি ফিরে গেলে খুব খুশি হবেন এলাকার মানুষজন।

রিজু মাস্টার কথায় কথায় মানবের কথা জিজ্ঞেস করেন। স্কুল জীবন থেকেই আকাশ-সুমন-মানব এদের গভীর বন্ধুত্ব। যেন এক প্রাণ। একটি বৃন্তে তিনটি ফুল। তিনি জানতে চান মানব কেন আসেনি তার প্রিয় স্যারের সঙ্গে দেখা করতে?

মানবকে সবাই মানু বলে। ওর কথা জিজ্ঞেস করতেই আকাশের মুখটা কেমন যেন পাংশুটে হয়ে গেল। সুমন মুখ ফিরিয়ে কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করলো। রিজু মাস্টার বুঝতে পারলেন কিছু একটা অঘটন ঘটেছে। কিন্তু কী হয়েছে তার প্রিয় ছাত্রের! জানার জন্য ছটফট করতে লাগলেন তিনি।

…….স্যার,মানু আপনার আদর্শে বড়ো হতে চেয়েছিলো কিন্তু………!! কিন্তু, ও হেরে গেল স্যার! আপনার স্বপ্ন ও পূরণ করতে পারেনি। ওর সঙ্গে খুব অন্যায় হয়েছে স্যার!

থেমে যায় আকাশ। কথা বলতে গিয়ে আটকে যায়। ঠোঁট কেঁপে ওঠে তার।

……কী হয়েছে আমাকে বল। আমি ধৈর্য হারিয়ে ফেলছি আকাশ। মানব ঠিক আছে তো?

……. না স্যার! ও আর আমাদের মধ্যে নেই! কয়েক মাস আগে না ফেরার দেশে ওকে পাঠিয়ে দিয়েছে এই নিষ্ঠুর সমাজ।

কেঁদে ওঠে সুমন। আকাশের বাক রুদ্ধ হয়ে যায়। রিজু মাস্টারের চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। কেমন যেন ওলট পালট হয়ে যায় সব। উথাল পাথাল করতে থাকে তার আবেগী মন। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে আকাশকে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছিল আমাকে খুলে বল।

আকাশ কিছুটা সামলে নিয়ে বলতে শুরু করে। আপনি স্কুল ছেড়ে চলে আসার পরের বছর আমরা তিনজন কোলকাতার একটা কলেজে ভর্তি হই। কলেজ ছাত্রাবাসে একসাথেই থাকতাম। গরমের ছুটিতে আমরা সবাই বাড়ি আসি। তারপরই এই অঘটন হয়।

……. সেদিন নীল আকাশের পশ্চিম কোণ কালো মেঘে ছেয়ে গেছিল। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। সকলের মনে আতঙ্ক। এক্ষুনি ঝড় উঠবে। তার নির্মম আঘাতে পৃথিবীর মানচিত্রের যেন পরিবর্তন ঘটবে। প্রকৃতির চোখে তারই ইশারা লক্ষ্য করে মানু।

বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এক নাগাড়ে অঝোরে ঝরে চলেছে। রাক্ষুসী মেঘপুঞ্জ মাঝে মধ্যে বিশ্রী দাঁত বের করে অট্টহাস্যে গোটা আকাশের বুকে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। জলের ঝাপটায় সমস্ত শরীর ভিজে গেছে ওর। শ্যাম্পু দেওয়া তুলোর মত চুলগুলো ভিজে সিঁথিতে বসে গেছে। ঝোড়ো হাওয়ায় তার শরীরে কাঁপুনি ধরেছে। অথচ কপালের ভাঁজে জমা হয়েছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কেন,কী হয়েছে তার? কী ভাবছে মানু? তার ভাবনার সাথে প্রকৃতি কি আজ সহমত! কেন প্রকৃতি আজ এতো উত্তাল,উদ্বেল?

মানু আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে চলেছে। সব কিছুকে যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করার মতো বয়স হয়েছে তার। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বুঝতে শিখেছে। কিন্তু সমাজ তার এই মূল্যবোধের মূল্য দেয়নি। কিছুদিন আগে তার সহপাঠী জুয়েল তার সঙ্গে বাড়িতে দেখা করতে এসেছিল। মানু পারেনি তার সম্মান রক্ষা করতে! কুলীন পিতা জাত বর্ণের অহঙ্কারে অন্ধ হয়ে জুয়েলকে অনেক কটু কথা শুনিয়েছিলেন। বাবার যুক্তি, মুসলমান ছেলে বাড়িতে ঢুকলে বাড়ি অপবিত্র হয়ে যায়। তাদের সঙ্গে খেলে জাত চলে যায়। জুয়েল সেদিন নীরবে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রেখে গিয়েছিল একটি প্রশ্ন,
………”কাকা বাবু, আপনাদের জাত কি এতোই ঠুনকো যে খুব সহজেই ভেঙে যায়? আপনারাই না বলেন, নর-ই নারায়ণ। জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর? তবে…………….!

মানু আজ মূক ও বধির হয়ে গেছে। শাস্ত্রীয় জ্ঞানে পণ্ডিৎ পিতার নির্বোধ আচরণ মানুকে এমন করে দিয়েছে।মানু দেখেছে,– তার বাবা কীভাবে সারা বাড়ি গোবর জল ও গঙ্গা জল ছিটিয়ে বাড়িটাকে পবিত্র করলেন। তিনি কিছু বাসন পত্র আলাদা করে কিনে রেখেছেন। সেগুলোর দ্বারা কোনো অ-ব্রাহ্মণ বা নিঁচু জাতের মানুষের মাঝে মধ্যে সেবার কাজে লাগে। ওগুলোতে প্রায় কুকুর বিড়ালে মুখ দিয়ে থাকে। কখনো বাথরুমের পাশে, কখনো ধানের গোলার তলায় অপরিচ্ছন্ন জায়গায় সেগুলোকে রাখা হয়। এসব দেখে মানুর ভীষণ কষ্ট হয়। নিজের জাতের প্রতি একটা চাপা ঘৃণা অন্তরে জায়গা করে নেয়। হায়! এরাই নাকি সমাজের শ্রেষ্ঠ জাত! অসভ্য বর্বর সমাজকে সভ্যতা, ভদ্রতা শেখাবার দায়িত্ব ভগবান নাকি এদের হাতেই ন্যস্ত করেছেন!বেদ পাঠের একচ্ছত্র অধিপতি তারাই! গায়ত্রী মন্ত্র নাকি তাদের কন্ঠেই শোভা পায়!!

যে মুসলমানদের প্রতি মানুর বাবার এতো ঘৃণা, সেই মুসলমানদের করুণায় মানব আজ বাবার আদরের মানু হয়ে বেঁচে আছে। বাবার সব স্বপ্ন আশা ভরসা সেই। তবে কেন বাবা বোঝেন না ছেলের মনের কথা! তার প্রাণের কথা! মানুষের কথা তথা মানবতার কথা!!

মানুর বাবা চাননা ছেলের কোনো মুসলমান বন্ধু থাকুক, তাদের সঙ্গে মিশুক। কিন্তু শহরে লেখা পড়া করতে এসে বাবার অহঙ্কার ছেলে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। ওদের সঙ্গে থাকা, খাওয়া, সিনেমায় যাওয়া সব কিছুতেই ওরা তিন বন্ধু। তিনি জানেন আদরের মানুকে মৃত্যুর হাত থেকে এই আকাশ সুমন এরাই বাঁচিয়েছে। এক দুর্ঘটনায় প্রাণ বাঁচাতে কোলকাতার মতো স্বার্থপর জায়গায় মুসলমান ছেলে আকাশ নিজের রক্ত দিয়ে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছে। আহত মানুর যন্ত্রনায় ওরা দুজন চোখের জল ফেলেছে। সব মুসলমান তো খারাপ হয় না। তবুও কেন তিনি এমনটি করেন? মুসলমান নাম শুনলে কেন নাক সিটকিয়ে ওঠেন?

সুমন একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, আচ্ছা কাকা বাবু, কেন আমাদের সম্পর্কে আপনি বাজে ধারণা মনে পুষে রেখেছেন? আমরা মুসলমান বলেই কি আমরা খারাপ? আমাদের রক্তটাও ? যদি তাই হয় তাহলে এই হতভাগ্য দুই মুসলমান ছেলের অপবিত্র রক্ত এখন আপনার ছেলের শরীরে বইছে, আপনি কি পারবেন সমস্ত রক্ত শরীর থেকে নিংড়ে বের করে দিয়ে ছেলেকে পবিত্র করতে?কোন মন্ত্রবলে, কোন গঙ্গা জল ছিটিয়ে তাকে আজ শুদ্ধ করে জাতে নেবেন?

সুমনের কথাগুলো শুনে মানুর দুই পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে সরে যাচ্ছিল। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিল ও। সুমনের কথাগুলো বারবার তার কানের কাছে ঘুরে ফিরে আসে, “তুই শিক্ষিত ছেলে মানু। তোর বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা কর, ধর্ম বর্ণ জাত দিয়ে মানুষকে বিচার করলে অন্যায় হবে। মানুষকে মনুষত্ব দিয়ে বিচার করতে হয়। তোদের আমাদের সবারই রক্ত এক,একই রং। তবে কোথায় আমাদের ফারাক? কোথায় বৈষম্য?কেন বৈষম্য? তোরা বলতে পারিস হাজার হাজার হিন্দু মুসলমান জাত বেজাতের রক্ত, রক্তদান শিবির থেকে ব্লাড ব্যাঙ্কে জমা হচ্ছে। মুমূর্ষু রোগীর প্রয়োজনে তোদের মতো জাতের অহঙ্কারী মানুষগুলো কি সেখান থেকে রক্ত গ্রহণ করে না? তখন কোথায় থাকে তোদের জাত নামক অদৃশ্য বস্তুটি। এই অসুস্থ সমাজকে সুস্থ করতে হবে মানু। এবং সেটি আমাদের মতো শিক্ষিত ছেলেদেরই এগিয়ে আসতে হবে।”

মানব মাথা নিচু করে শোনে সুমনের কথাগুলো। এই সব প্রশ্নের উত্তর জানা নেই তার। সুমন সেদিন বলেছিল,-” আমি জানি মানু, আমাদের প্রতি তোদের কেন এতো ঘৃণা,এতো বিদ্বেষ। এজন্য শুধু তোর বাবাকে দায়ী করলে ভুল হবে । এর জন্য দায়ী আমাদের সমগ্র সমাজ। দায়ী আমাদের মনগড়া ইতিহাসের মিথ্যা গল্পগুলো। দায়ী আমাদের তথাকথিত দেশবরেণ্য নেতাগুলো।যারা ধর্ম নিয়ে মেকি রাজনীতি করে। ধর্মের প্রাচীর তুলে মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে। দায়ী কিছুসংখ্যক মানুষ,যারা মানুষের পোষাক পরে হিংস্রতার বিষ ছড়ায়। এরাই জাতির কুলাঙ্গার। মানবতার শত্রু। এদের দিয়ে সমস্ত সম্প্রদায়কে বিচার করা ঠিক নয়। এদের অবস্থান সব সমাজে। এরা ধর্মের ধার ধারেনা। এরা না হিন্দু, না এরা মুসলমান।” এক নিঃশ্বাসে সুমন কথাগুলো ছুড়ে দিয়েছিল মানুর দিকে। মানু চুপ ছিল। কথা বলতে পারে নি। মানুর আজ সব মনে পড়ে। নিজেকে তার খুব ছোট মনে হয়।

অনেকক্ষণ ধরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। প্রকৃতি যেন পাগলের দেশে পাগলা বাতাস নিয়ে প্রবেশ করেছে। তার খেয়ালিপনায় প্রতিবেশী শর্বরীদের ঘরের চালা থেকে খড় উড়ে যাচ্ছে। রাস্তায় একটিও জনপ্রাণী নেই। জলের ঝাপটায় মানু কাক ভেজা হয়ে গেছে। হঠাৎ একটা নরম হাতের স্পর্শে পেছন ফিরে তাকায়।

……..কে? ও !…. বিউটি!

…..মানুদা তোমার কী হয়েছে গো?সেই কখন থেকে এখানে বসে আছো।

……..না, কিছু হয়নি।

……. তবে তুমি এখানে বসে এভাবে ভিজছো কেন? অসুখ করবে যে।

……… তুমি যাও বিউটি। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।

…….না। তুমি ঘরে চলো। মাসিমা রান্না করেছেন। তুমি খাবে চলো।

অবশেষে মানুকে যেতেই হলো। ও জানে বিউটির কথা না শুনলে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যাবে। বিউটি কষ্ট পাক মানু তা চায়না।কারণ, বদ্ধ পৃথিবীর মানুষগুলো থেকে ও একটু আলাদা। ডাগর ডাগর চোখের চাহনি মানুকে মুক্ত পৃথিবীর সন্ধান দেয়। সেই স্কুল জীবন থেকে তাদের বন্ধুত্ব। তারপর ধীরে ধীরে দুজন দুজনের ভবিষ্যতের স্বপ্ন। মানুর অনুপ্রেরণা। বিউটির জন্যই মানু জীবনে কখনো ভেঙ্গে পড়েনি। তার আশা ভালবাসা স্বপ্ন সবের মধ্যেই যেন বিউটির অবাধ যাতায়াত। ওর কথা ভাবতে ভালো লাগে। মনে হয় পৃথিবীর সব মানুষগুলো যদি বিউটির মতো হতো তাহলে কতোই না ভালো হতো।

থালা ভর্তি গরম খিচুড়ি নিয়ে বিউটি মানুর সামনে এসে দাঁড়ায়।

মানুর মুখটা যেন হঠাৎ ই ম্লান হয়ে যায়। একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের মধ্যে টেনে ছেড়ে দেয়।

…….মানুদা!এই মানুদা!কী হলো?

….. খিচুড়ি নিয়ে যাও বিউটি।

…..কেন?

…….. ইচ্ছে নেই।

বিউটি জানে মানু কেন খিচুড়ি খাবেনা। খিচুড়ি প্রসঙ্গ কিছুতেই ভুলতে পারে না ও।

মানু তখন এলাকার ভেড়ামারা হাই স্কুলে পড়াশোনা করতো। স্কুলে একবার চাঁদা তুলে শিক্ষক-ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে খিচুড়ি ভোজের আয়োজন হয়েছিল। তার সহপাঠী জুয়েল, আকাশ, সুমন খাবার পরিবেশন করতে গিয়ে গোল বাধে।স্কুলের অতিথি হয়ে আসা তিনকড়ি,কালু হালদাররা বলে ওঠেন মুসলমান ছেলেদের ছোঁয়া খাবার তারা খাবেন না। খেলে নাকি তাদের জাত চলে যাবে। পরিস্থিতি যখন বেসামাল তখন অবোধ মানু জাতের নামে বজ্জাতির বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ জানিয়ে রিজু স্যারের সঙ্গে একই পাত্রে খিচুড়ি খেয়েছিল। সেদিন নাকি মানুর জাত চলে গিয়েছিল। মানুকে গোবর জল আর গঙ্গা জলে স্নান করিয়ে নানা তন্ত্র মন্ত্র পাঠের পর সমাজ তার চলে যাওয়া জাতকে ফিরিয়ে দিয়েছিল।

মানুর ঘৃণা হয় এমন অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক ঠুনকো জাতের জন্য। লজ্জা হয় জাতের ঠুনকো ধ্বজাধারী মানুষগুলোর উপর। সেদিন থেকে একটা অব্যক্ত যন্ত্রণায় মানু ছটফট করে।

মানুর কষ্ট দেখে বিউটির কষ্ট হয়। তাকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা বিউটির নেই। বিউটিরও তীব্র ঘৃণা হয় এমন নিকৃষ্ট প্রথাকে যারা জীবিত রেখেছে তাদের উপর। ভাবতে কষ্ট হয় একবিংশ শতাব্দীতেও মানুষ এসব
জাত-পাতে বিশ্বাস করে। মানুকে শান্ত হতে বলে সে। বলে, সমাজের এই নােংরা ভন্ডামির বিরুদ্ধে তােমার ধিক্কার তাদের কর্ণকুহরে পৌঁছাবে না মানুদা। তারা চোখে অন্ধ সেজে কানে তুলাে গুঁজে ধর্মের অপব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য।ভগবানের কাছে প্রার্থনা কর, তিনি যেন এদের একটু সুমতি দেন।

……. বিউটি ! তুমি বলতে পারাে, যে দেশে সমস্যার কোন শেষ নেই, কুসংস্কারের জন্য যে দেশের মানুষ সভ্য দেশের থেকে ছিটকে শত যােজন দুরে পড়ে রয়েছে, সে দেশের মানুষ কেন এই সব কৃত্রিম সমস্যাকে জিইয়ে রাখবে? যে দেশের অধিকাংশ মানুষ অসুখ হলে সঠিক চিকিৎসা করানাের মত খরচ
জোগাতে পারেনা, সন্তানকে সুশিক্ষা দিতে পারেনা, সুন্দর ভাবে বাঁচার মত পরিবেশ তৈরী করতে পারেনা, এদের মুখে এখনাে কি জাতের বড়াই মানায় বিউটি? যারা ধর্মের দোহায় দিয়ে, জাতের দোহায় দিয়ে হিন্দু – মুসলমান বিভেদ টিকিয়ে রেখেছে তার কি কোনদিন অবসান হবেনা? ধর্মের দোহায় দিয়ে কোন দেশের কখনােই উন্নতি হয়নি। ধর্মের জিগির তুলে কখনোই মানুষকে এক সুতােয় বাঁধা যায় না। দেশের উন্নতি ঘটানাে যায় না। আসলে ধর্মান্ধ হয়ে আমাদের মনুষত্বটাই হারিয়ে গেছে। ধর্মের অদৃশ্য প্রাচীরে আটকা পড়ে রয়েছে আমাদের মনুষত্ব। এই অদৃশ্য প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলতে হবে, গুঁড়িয়ে দিতে হবে।

মানু থেমে যায়। তার চোখে জল।

বিউটি বলে, তুমি ঠিকই বলেছ মানুদা। অজ্ঞতার ফলেই এই সব মনুষত্ব বিরোধী ব্যবস্থা আমাদের সমাজকে অক্টোপাসের ন্যায় জড়িয়ে ধরেছে। এ থেকে মুক্ত হতে গেলে চাই সুশিক্ষা। মানুষকে বােঝাতে হবে মানুষের পরিচয় মনুষ্যত্বে। পৌরানিক ধ্যান-ধারনার পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারনায় এদের মন পুষ্ট করতে হবে। তখনই দূর হবে অস্পৃশ্যতা, দূর হবে জাতি ভেদ, দূর হবে সাম্প্রদায়িক কোন্দল। গড়ে উঠবে জাত – পাত – বর্ণহীন এক সভ্য সমাজ।

মানুদের কথাবার্তা পাশের ঘর থেকে সব শুনেছেন বাবা। তার কণ্ঠস্বর পেয়ে বিউটি ঘর ছেড়ে দ্রুত বেরিয়ে যায়।

………মানু, এই মানু! তুই কি বিধর্মী হয়ে গেছিস! এই জন্যই কি তােকে টাকা পয়সা খরচ করে কোলকাতায় রেখে মানুষ করছি। আকাশ আর সুমনের পাল্লায় পড়ে তুই নষ্ট হয়ে গেছিস। রিজু মাস্টার তোর মাথাটা শেষ করে দিয়েছে। ধর্মের বিরুদ্ধে কি সব আজে বাজে বকছিস?

………..না বাবা! তুমি ভুল শুনেছো। ধর্মের বিরুদ্ধে আমি কিছু বলিনি। আকাশ সুমন আমাকে নষ্ট করেনি।আর রিজু স্যারের কথা বলছো? উনি আমাকে সঠিক পথ দেখিয়ে গিয়েছেন। উনি আমার আদর্শ শিক্ষক। উনার সম্বন্ধে কিছু বলোনা বাবা। ধর্মের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযােগ নেই। কিন্তু ধর্মের দোহায় দিয়ে যারা মানুষের মধ্য বিভেদ তৈরী করেছে, মানুষকে দুরে ফেলে দিয়েছে- আমার অভিযােগ তাদের বিরুদ্ধে । যারা ধর্মের দোহায় দিয়ে মনুষত্বকে , বিবেককে নিংড়ে বের করে ফেলেছে, ধর্ম নিয়ে যারা রক্তের হােলি খেলছে আমার অভিযােগ তাদের বিরুদ্ধে। ধর্ম নিয়ে যারা মেকি রাজনীতি করছে আমার অভিযােগ সেই সব ভণ্ড মুখােশধারী মানুষের বিরুদ্ধে বাবা।

……..এই সব ধর্ম-টর্ম নিয়ে তােকে মাথা ঘামাতে হবে না। তা ছাড়া ধর্মের কি বুঝিস তুই।

………অপরাধ নিওনা বাবা। ধর্ম সম্পর্কে কিছু না বুঝলেও এটা জানি, ধর্ম মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ
ঘুচায়। ধর্ম দেশ-কাল-পাত্রের উর্ধ্বে অবস্থান করে মানুষের মধ্যে মহামিলনের ক্ষেত্র তৈরী করে। ধর্ম শান্তি আনে ,মানুষকে ভালােবাসতে শেখায়। যে ধর্ম মানুষকে ভালবাসতে শেখায় না, যে ধর্ম অপর ধর্মকে, অপর সম্প্রদায়কে ঘৃণা করতে শেখায় সে ধর্মের কথা আমাকে বলো না বাবা। তােমাদের কাছে ধর্মই বড় বাবা, মানুষ বড় নয়। তােমাদের জেনে রাখা উচিৎ ধর্ম মানুষের জন্ম দেয়নি, মানুষ জন্ম দিয়েছে ধর্মের।

বাহিরে তখন প্রচন্ড বেগে ঝড় বইছে। মাঝে মাঝে গাছপালা ভাঙার মড় মড় শব্দ শােনা যাচ্ছে। পৃথিবী আজ উত্তাল। ঘন অন্ধকারে কাছের জিনিস ও ভাল করে দেখা যায় না। ভয়াল-ভয়ংকর পরিবেশ তৈরী হয়েছে বাহিরে, এবং তার সঙ্গে ঘরের মধ্যেও। মানুর অন্তরের ঝড় আজ বাহিরের ঝড়কে হার মানিয়েছে। তার বিদ্রোহী মন আজ পিতার সম্মুখে বিদ্রোহ ঘােষণা করেছে।

মানুর বাবা রাগে ফুঁসছেন। এতদিন তিনি দুধ-কলা দিয়ে সাপ পুষেছেন। তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না,যে ছেলে তাকে উঁচু স্বরে কোনদিন কথা বলেনি, কখনাে কোন কথার অবাধ্য হয় নি। সে কি না আজ! এত বড় স্পর্ধা! রিজু মাস্টারই এর গোড়া।উনিই ছেলের মাথাটা খেয়েছেন। ঐ মাস্টার স্কুল ছেড়ে গেলেও ছেলের মাথা থেকে যাননি। রাগে সমস্ত শরীরের হাড়-মাংস জ্বলে উঠলাে তার। খুন টগবগ করে ফুটছে সারা শরীরে। মাথায় আগুন চড়ে গেছে । ঠক্ ঠক্ করে কাপছে সারা শরীর। হঠাৎ সটান তার ডান হাতটা চলে গেল পাশেই রাখা ধারালাে ছুরিটার উপর। শক্ত করে ধরলেন ছুরির বাটটা। তারপর এক সময় আচমকা বসিয়ে দিলেন উদ্ধত পুত্রের উন্নত বক্ষে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলাে। মানু মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। ডান হাতটি বাবার দিকে তুলে একটু উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে আবার মাটিতে পড়ে গেল। আর নড়লো না!

Related Articles

Back to top button
error: