সাহিত্য ও সংস্কৃতি

গল্পের নাম:- “রিজু বাঁচতে চেয়েছিলো” গল্পকার:- মোস্তফা কামাল (পর্ব ২৭)

(পর্ব ২৭)

রাত আটটার সংবাদটি শুনে টিভিটা অফ করতেই অপরিচিত নম্বর থেকে রিজুর ফোন বেজে ওঠে। ফোনটি ধরে হ্যালো বলতেই ওপারে চেনা অচেনা নারী কন্ঠ ভেসে আসে।

……….. হ্যালো! রিজু বলছিস?

……….. হ্যাঁ বলছি। কিন্তু আমি তো চিনতে পারলাম না।

……. আমি সামিমা বলছি রে।

………. খুব চেনা কন্ঠ। চেনা নাম। ভেতরটা কেমন কেঁপে যায় রিজুর। চাপা কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে কোন সামিমা?

………. জানি তুই ভুলে গেছিস। আমি কিন্তু ভুলিনি। রফিকের কাছ থেকে তোর নম্বর নিয়ে ফোন করছি।

………. রফিক! কোন রফিক?

রিজুর বুকের ভেতর উথাল পাথাল ঢেউ শুরু হয়েছে। বড়ো বড়ো ঢেউ আছড়ে পড়ছে তার হৃদয় সমুদ্র তীরে। ঠোঁট দুটি আপনা আপনি কেঁপে উঠছে। কোনো মতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না। সেই সামিমা! ইউনিভার্সিটির সামিমা! যে তার জন্য চোখের জল ফেলেছিল,সেই সামিমা! কিছুতেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না তার।

………. হ্যালো! কথা বলছিস না কেন রিজু?

……… হ্যাঁ,হ্যাঁ! বলছি তো। তুই ভালো আছিস। কথা বের হতে চাইছেনা রিজুর গলা থেকে।

………… হ্যাঁ ভালো আছিরে। আমি এখন তোদের শহরে। হাজার দুয়ারী দেখতে এসেছিলাম সপরিবারে। আজ রাতটা বহরমপুরে হোটেলে এসে উঠেছি। খুব সকালে বেরিয়ে যাবো। তুই আয়। অনেক ক’বছর তোর সাথে দেখা নেই। আমার বর তোর সাথে আলাপ করবেন বলছেন। তাছাড়া তোদের শহরে এসে তোর সাথে দেখা না করে কি যেতে পারি? আর শোন, তুই ভাবিকেও সাথে নিয়ে আয়। সবার সাথে পরিচয় হয়ে যাবে। খুব ভালো লাগবে।

………. আমি, আমি নিশ্চয়ই দেখা করবো। কিন্তু, তোর উপর আমার একরাশ অভিযোগ রয়েছে।

………… কী অভিযোগ রে? খিলখিল করে হেসে ওঠে সামিমা। সেই হাসি। পঁচিশ বছর আগে প্রায়ই এমনই হাসি হাসতো ও। এম এ ক্লাস করার সময় রিজুর পাশেই সামিমা বসতো। ও খুব প্রাণোচ্ছ্বল মেয়ে। দুঃখকে ও সহজেই জয় করতে পারে। ওকে ছেড়ে যেদিন রিজু চলে এসেছিল সেদিন ও খুব কাঁদেছিল । তারপর দীর্ঘ বিরতি। পঁচিশটি বছর! আজ হঠাৎ….. আবার সেই মন ভালো করা সেই হাসি। কতদিন এমন হাসি রিজু শোনেনি। রিজুর হৃদয়ে যেন বসন্তের কোকিল ডেকে ওঠে। মরা গাঙ্গে বান আসে।

……… আমার বাড়ি থাকতে তোরা হোটেলে উঠলি কেন? তুই কি জানতিস না আমি বহরমপুর থাকি?

………. হ্যাঁ জানতাম। আমাকে রফিক একদিন বলেছিল তুই নাকি বহরমপুর বাড়ি করেছিস। আমার মনে আছে তাইতো তোকে ফোন করেছি। সারাজীবন তোর সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা অটুট থাকুক আমি চাই। বাড়ি গিয়ে সেটাকে নষ্ট করতে চাইনা রে! আজ কতদিন পর তোকে কাছে পাবো। কতো গল্প করবো। এসব ভাবতে আমার ভীষণ ভালো লাগছে। তুই তাড়াতাড়ি আয়। দেরি করিসনা। আর শোন, এখানেই আমরা এক সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করবো ঠিক আছে?

……. হুম। ঠিক আছে। এই আমি আসছি । ফোন রেখে দেয় রিজু।

আজ কত বছর পর সামিমার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে রিজু। এ এক অন্য রকম অনুভূতি। মিতাকে ওখানে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।ওকে বলা মানেই অশান্তি ডেকে আনা। মিতা ভুল বুঝবে। ও এমনিতেই অনেক কিছু ভেবে বসে থাকে। ইউনিভার্সিটির ছাত্র জীবনে সামিমার কথা বললেই মিতা রাগ দেখায়। কথা বলা বন্ধ করে দেয়।অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। কোনো মেয়ের সাথে রিজুর সম্পর্ক থাক তা মিতা চায় না। হোক সে বন্ধুত্ব বা অন্য কোনো সম্পর্ক।

রিজু প্যান্ট শার্ট পরে বের হয়। রান্না ঘর থেকে মিতা দেখে। হঠাৎ ও সামনে এসে দাঁড়ায়। এই ভয়টাই রিজু করছিলো। বলে, তুমি এই রাতে কোথায় যাচ্ছো?

……… এই একটু বাইরে যাচ্ছি। এই যাবো আর আসবো।

………. হঠাৎ বাইরে কেন? এতক্ষণ তুমি কার সাথে ফোনে কথা বলছিলে?

রিজুর আর কথা সরে না। আমতা আমতা করে বলে এই একজন বন্ধুর সঙ্গে। ও কোলকাতা থেকে বহরমপুর এসে একটা হোটেলে উঠেছে। দীর্ঘদিন পর দেখা হবে।

…… কোন বন্ধু এসেছে তোমার? কী নাম?

এই রে সেরেছে। নাম বললেই তো বিপদ। তাতে আবার রাতের বেলা। হোটেলে। কিন্তু রিজু মিথ্যা বলতেও পারেনা। আজ পঁচিশটি বছর মিতার সঙ্গে ঘর করছে, আজ পর্যন্ত একটা কথাও লুকাতে পারেনি। তার সব খবর মিতা জানে। তাই রিজু মিথ্যা বলে এড়িয়ে যেতে পারে না। আবার সত্যিটাও বলতে ভয় পায়।

………… কি গো, বলছো না যে?তোমার কোন বন্ধু? কী নাম তার?

………. আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধু। সামিমা।

তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল মিতা। ফুঁসতে ফুঁসতে বলে উঠে, ঠিক আছে যাও! আমিও বেরিয়ে যাচ্ছি!

.…… তুমি আবার কোথায় যাবে? আমার সঙ্গে চলো।

……… হুঁহ! তোমার সাথে আমি যাবো ? যে লোক নিজের স্ত্রীকে লুকিয়ে প্রেমিকার সাথে দেখা করতে যায় তার সাথে?

………. তুমি এসব কী বলছো মিতা! ও আমার ক্লাসমেট। এখন নামকরা কলেজের অধ্যাপিকা। ওর সম্পর্কে তোমার এসব বলতে মুখে আনতে বাধলো না? ছিঃ মিতা ! ছিঃ!

…….. না ,বাধলো না! যার ছোঁয়ায় আমার সংসারে আগুন লাগে তার সম্পর্কে বলতে আমার বাধে না। এই তানু জামা কাপড় পরে নে। আমরা এক্ষুনি চলে যাবো।

……….. কোথায় যাবে?

……….. যে দিকে দুই চোখ যাবে সেই দিকে।

……… তুমি এটা ঠিক করছো না মিতা। সামিমার সাথে আজ পঁচিশটি বছর পর কথা হলো। ও বহরমপুর এসেছে। বন্ধুত্বের খাতিরে ওর সঙ্গে দেখা করা উচিত। তুমি এতো ছোট মনের কেন বলো তো?

মিতা দ্রুত রান্নাঘরে ছুটে গিয়ে থালা বাসন ছুঁড়তে থাকে। ভাতের হাঁড়িটা ঠকাস করে নামিয়ে ওভেন নিভিয়ে দেয়। চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ে। রিজু পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। বিড়বিড় করতে করতে মিতা শাড়ি পরতে শুরু করে। তানু জামা প্যান্ট পরে রেডি হয়।

রিজু তানুকে চেপে ধরে। জিজ্ঞেস করে, আমাকে ছেড়ে কোথায় যাবে তানু?

…… মা যেখানে যাবেন সেখানে।

মিতা খেঁকিয়ে উঠে। বলে, তোমার যা খুশি তাই করো। মাগীদের নিয়ে মরো আর না হয় ফূর্তি করো আমি আর কিছু বলবোনা। অনেক বলেছি। কোনোদিন একটা কথাও আমার শোনো নি। আমি জানি তুমি শুনবেও না। তাই তোমাকে নিষেধ করবোনা। তোমার যা ইচ্ছা হয় তাই করো। তুমি দেখে নিও, তুমি বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবো।

রিজু কী করবে ভেবে পায়না। মনের ভিতরটা ছটফট করে। ওদিকে সামিমা অপেক্ষা করছে। না গেলে হয়তো অপেক্ষা করতে করতে ও ক্লান্ত হয়ে পড়বে। রিজুর উপর অভিমান করবে। ভুল ভাববে। কিন্তু গেলেও বিপদ। তার থেকে নীরবে কষ্ট সহ্য করে মিতাকে সান্ত্বনা দিয়ে সংসারটা ঠিক রাখতে হবে।

মিতার এই ধরনের আচরণ রিজুর একদমই ভালো লাগে না। সে তো একজন মানুষ নাকি! তার তো কিছু স্বাধীনতা থাকে। কিন্তু মিতা যেন তার সমস্ত স্বাধীনতা হরণ করে নিয়েছে। রিজু এখন একটা যন্ত্র মাত্র। ওর বিরুদ্ধে গেলেই ও তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। সংসারে আগুন লাগিয়ে দেয়। এটাই ওর চরিত্রের বড়ো দোষ। সম্মানের ভয়ে রিজুকে সব মানিয়ে নিয়ে চলতে হয়।

রিজু শার্ট খুলে চেয়ারে বসে পড়ে। অবোধ স্ত্রীর নির্বোধ আচরণের জন্য রিজু কষ্ট পায়। সামিমার কাছে ছোট হয়ে যায়। কাছে পেয়েও তার সঙ্গে দেখা করতে না পারার জন্য মনটা খারাপ করে। ওকে ফোন করে কাঁপা কাঁপা গলায় জানিয়ে দেয়, আমার যাওয়া হচ্ছে না রে সামিমা। অন্য কোনো দিন নিশ্চয়ই দেখা হবে। মিতা শান্ত হয়।

Related Articles

Back to top button
error: