খেলা

‘দেশের জন্যে খেলছি , জাত তোলা কেনো ?’, জাতপাত নিয়ে খোঁটা দেওয়ার তীব্র নিন্দা করলেন বন্দনা

টিডিএন বাংলা ডেস্ক :  টোকিও অলিম্পিক্সে ভারতের মহিলা হকি টিম আর্জেন্টিনার কাছে সেমিফাইনাল হেরেছে। আর ঠিক তার পরেই এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গিয়েছে। যার সাক্ষী থাকল ভারতীয় হকি দলের দলের তারকা খেলোয়াড় বন্দনা কাটারিয়ার পরিবার! ভারত শেষ চারে হারায় তাঁদের বর্ণবৈষম্যমূলক কটুক্তি করা হয়। এমনকী জাত তুলেও আক্রমণ করা হয়েছে। হরিদ্বারের রোশনাবাদ গ্রামে উচ্চ বর্ণের মানুষের দ্বারা হেনস্তার শিকার বন্দনার পরিবার।

অলিম্পিক্সে ভারতীয় অ্যাথলিটরা নিজের মতো চেষ্টা করতে কসুর করছেন না ৷ দেশবাসী করোনাকালে সমর্থণের ঝুলি উজাড় করে দিচ্ছেন কিন্তু এরমধ্যেও বেশ কিছু ঘটনা ভীষণ খারাপভাবে রেখাপাত করছে ৷
টোকিও অলিম্পিক্সে মেয়েদের ব্যাডমিন্টন সিঙ্গলসে ব্রোঞ্জ জিতলেন পিভি সিন্ধু। বহু মানুষ, বিশেষত উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান ও হরিয়ানা থেকে গুগলে সার্চ করতে শুরু করলেন, সিন্ধু কোন জাত– ব্রাক্ষণ না কায়স্থ না অন্য কিছু। অন্যদিকে টোকিও অলিম্পিক্সে মেয়েদের বক্সিং-এর ওয়েল্টার ওয়েট বিভাগে ব্রোঞ্জ জিতলেন লভলিনা বড়গোঁহাই। মুহূর্তে গুগল ভরে গেল একটি নির্দিষ্ট সার্চ-এ , লভলিনা কোন ধর্ম সম্প্রদায়ের– হিন্দু না মুসলিম না ক্রিশ্চান!

এ বারই প্রথম অলিম্পিক্স হকিতে সেমিফাইনালে উঠেছিল ভারতীয় মহিলা হকি টিম। বন্দনা নিজেও চমৎকার পারফর্ম করেন, অলিম্পিক্সের ইতিহাসে প্রথম ভারতীয় মহিলা হকি খেলোয়াড় হিসেবে তিনি হ্যাটট্রিক-ও করেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে। কিন্তু সেমিফাইনালে আর্জেন্তিনার কাছে হেরে যেতেই বন্দনার রোশনাবাদের বাড়ির সামনে বাজি ফাটানো শুরু হয়! এই উল্লাসের কারণ খুব স্পষ্ট– দলিত মেয়ে-র টিম হেরে গিয়েছে। এর সাথে সাথে উড়ে আসে ‘জাত’ তুলে অশ্রাব্য গালিগালাজ। এমনকি বন্দনা-কে ব্যক্তিগত ভাবেও কুরুচিকর ভাষায় আক্রমণ করা হয়।

টোকিয়োয় আসার পর থেকে ফোন বন্ধ রেখেছিলেন , ফলে যোগাযোগ হয়নি পরিবারের সঙ্গে। অলিম্পিক্স কভার করতে আসা ভারতীয় সাংবাদিকদের মুখেই শুনেছেন যে তাঁর বাড়ির লোককে কী ভাবে জাতপাত নিয়ে খোঁটা শুনতে হয়েছে।

শুক্রবার গ্রেট ব্রিটেনের বিরুদ্ধে ব্রোঞ্জ পদকের ম্যাচে হারের পর বন্দনা বলেছেন, “আমরা সবাই দেশের জন্য খেলি। কিন্তু জাতপাত নিয়ে যেটা হচ্ছে, সেটা একদমই ঠিক হচ্ছে না। কিছু কিছু জিনিস আমার কানে এসেছে, সেগুলো শুনে খুবই খারাপ লেগেছে।”
বন্দনা আরও বলেছেন, “আমরা শুধু হকির ব্যাপারেই ভাবি। দলে তরুণ মেয়েরাও রয়েছে। প্রত্যেকে এক হয়ে খেলি। সবারই শ্রদ্ধা প্রাপ্য।”

এই সেদিন প্রথম ভারতীয় মহিলা হকি খেলোয়াড় হিসেবে অলিম্পিক্সে হ্যাটট্রিক করেছেন। সেদিন সারা দেশ তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু তার দু’দিনের মধ্যেই তার দল আর্জেন্টিনার কাছে পরাজিত হতেই তার বাড়ির সামনে পটকা ফাটাতে শুরু করে উচ্চবর্ণের এই লোকেরা। বন্দনার মা বলছিলেন, “বিকেল তখন পাঁচটা হবে। আমরা সবাই টিভিতে ম্যাচ দেখছিলাম। হঠাৎই বাড়ির বাইরে পটকা ফাটতে শুরু করে।”

এমনিতে ভারতীয় নারী দল সেমিফাইনালে পরাজিত হওয়াতে সবার মন খারাপ। কিন্তু তার মধ্যেই বাজি কেন ফাটছে , পাড়ার লোক আর পরিবারের সদস্যরা খোঁজ করতে গিয়ে শুনলেন ‘বন্দনা কাটারিয়া মুর্দাবাদ’র মতো স্লোগান।

যারা বাজি ফাটাচ্ছিল, তাদের বলতে শোনা যায়, বন্দনা কাটারিয়ার মতো দলিত সমাজের মানুষ দলে ঢুকেছে বলেই ভারত হেরেছে। প্রশ্ন তোলেন যে দলিত হয়ে কী ভাবে ভারতীয় দলে সুযোগ পাচ্ছেন বন্দনার মতো খেলোয়াড়।

বন্দনার বড়ভাই চন্দ্রশেখর কাটারিয়া সংবাদসংস্থা বিবিসিকে বলছিলেন, “হ্যাঁ, আমরা চামার জাতির মানুষ। জাত তো বদলাতে পারব না। কিন্তু তা বলে যে মেয়েটা দেশের জন্য খেলতে গেছে তার নামে মুর্দাবাদ স্লোগান দেবে? জাত তুলে কথা বলবে!”

ঘটনা প্রসঙ্গে বন্দনার ভাই শেখর মিডিয়াকে বলেন, “সেমিফাইনালে ভারতের হারের জন্য আমরাও দুঃখিত ছিলাম। ম্যাচ শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই প্রচণ্ড আওয়াজ পেয়ে বাড়ির বাইরে চলে আসি আমরা। এসে দেখি দু’জন বাজি ফাটাতে ফাটাতে নাচছেন। তাঁরা বলতে থাকেন যে, দলিত খেলোয়াড়দের দল থেকে বার করতে হবে, ভারতীয় দলে অনেক দলিত খেলোয়াড় আছে, তাঁদের জন্যই হারতে হয়েছে আমাদের। জাতের ভিত্তিতেই আমাদের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে।”

বন্দনা কাটারিয়ার পরিবার গোটা ঘটনায় ভীষণ ভেঙে পড়েন৷ তাঁরা স্থানীয় পুলিশ থানায় ঘটনার রিপোর্ট করেন৷ পুলিশ দুই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে৷ পুলিশকে তাঁরা গোটা ঘটনার রিপোর্ট করেন৷ কাটারিয়ার পরিবার জানিয়েছে তাঁরা নিজের পরিবারের মেয়েকে নিয়ে গর্বিত৷ পাশাপাশি ভারতীয় মহিলা হকি দলের লড়াকু পারফরম্যান্সকে কুর্নিশ করেন৷

সংকীর্ণ এই জাতপাতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন ভারতীয় মেয়ে হকি দলের নেত্রী রানি রামপাল। রানি বলেছেন, ‘আমরা যখন মাঠে লড়াই করি তখন আমাদের একটাই পরিচয় থাকে, আমরা ভারতীয়- তাই জাতপাতের সংকীর্ণতা তোলা বাতুলতা।’

বন্দনার পরিবারকে জাতপাতের খোঁটা দেওয়ার অভিযোগে এখনও পর্যন্ত মোট তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আগেই ধরা হয়েছিল অঙ্কুর পাল এবং সুমিত চৌহানকে। শুক্রবার ধরা পড়ে মূল অভিযুক্ত বিজয় পাল। তাদের বিরুদ্ধে অপমান এবং শান্তিভঙ্গের ধারায় মামলা করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই বিজয় পল আবার উত্তরাখণ্ডের হয়ে জাতীয় হকিতে খেলে। হরিদ্বারে বন্দনার বাড়িতে পুলিশ চৌকি বসাতে হয়েছে।

হরিদ্বারের সিনিয়ার পুলিশ সুপারিন্টেডেন্ট সেন্থিল আভুদায়ি কে রাজ এস বলছেন, “বন্দনা কাটারিয়ার ভাই আমাদের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন যে ভারতীয় দল হেরে যাওয়ার পরে কিছু ব্যক্তি তার বাড়ির সামনে আতশবাজি ফাটিয়েছিল, জাতি তুলে আপত্তিজনক কথা বলেছিল। ভারতীয় দন্ডবিধিতে যেমন মামলা হয়েছে, তেমনই তপশিলী জাতি-উপজাতি আইনেও মামলা করা হয়েছে। একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”

এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার সাথে সাথেই সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র নিন্দার ঝড় উঠেছে। এই ঘটনা নিয়ে সরব হয়েছে বিভিন্ন দলিত সংগঠন গুলোও। স্বরাজ ভারতের সভাপতি যোগেন্দ্র যাদব টুইট করে বলেন, ‘শুধু দলিত বলেই একজন জাতীয় হিরোকে এ ভাবে অপমানিত হতে হল।’ অল ইন্ডিয়া মহিলা কংগ্রেসের জাতীয় কনভেনর রুচিরা চতুর্বেদী আরও একধাপ এগিয়ে বলেন, ‘গোটা দেশের পক্ষ থেকে আমাদের বন্দনা ও তাঁর পরিবারের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।’

Related Articles

Back to top button
error: